জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৪

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা

মুক্তিবাণী অনলাইন ডেস্ক :

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে উপকূলে শুরু হয়েছে ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি। এতে স্বাভাবিকের চেয়ে নদ-নদীতে জোয়ারের পানি তিন থেকে পাঁচ ফুট বাড়ায় কুয়াকাটায় তলিয়ে গেছে বাড়িঘর, দোকানপাট। বাগেরহাটে স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও খাদ্যগুদাম হাঁটু পানির নিচে রয়েছে বলে জানা গেছে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সতর্কতামূলক মাইকিং করাসহ আশ্রয়কেন্দ্র এবং চিকিৎসক দল প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

ভারতের উড়িষ্যা- পশ্চিমবঙ্গ উপকূলের দিকে প্রচণ্ড গতিতে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। এর প্রভাবে উত্তাল বঙ্গোপসাগর। এরইমধ্যে ঝড়ের প্রভাব দেখা দিয়েছে দেশের দক্ষিণ- পশ্চিম উপকূলীয় জেলাগুলোতে। প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়া, বৃষ্টি আর বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে সমুদ্র তীরে। জোয়ারের পানি ঢুকছে নিচু এলাকা এবং চরাঞ্চলে। এরই মধ্যে বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে বেশ কিছু এলাকা।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আরও ঘনীভূত ও উত্তর-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে আজ বুধবার দুপুর নাগাদ উত্তর উড়িষ্যা-পশ্চিমবঙ্গ উপকূল অতিক্রম করবে। এসময় এটি প্রবল থেকে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় রূপ নিতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। মঙ্গলবার আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস প্রবল থেকে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবে রূপ নিয়ে ভারতে আঘাত হানতে পারে। তবে বাংলাদেশের খুলনাসহ উপকূলীয় এলাকা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি জোয়ার এবং ঝড়ো বাতাসের মুখে পড়বে।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কারণে দেশের সব সমুদ্রবন্দরকে তিন নম্বর সতর্কসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত প্রবল ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আরও উত্তরপশ্চিমে অগ্রসর হয়ে বর্তমানে একই এলাকায় অবস্থান করছে।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কারণে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সারাদেশে সকল নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বি আইডব্লিউটিএ। মঙ্গলবার (২৫ মে) এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে বি আইডব্লিউটিএ।

খুলনা অফিস : আম্পানের পর এক বছর অতিবাহিত হলেও খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলে এখনো জরাজীর্ণ পাউবোর বেড়িবাঁধ। যা নিয়ে আতঙ্কে সময় পার করছেন উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা বেড়িবাঁধ এলাকার সাধারণ মানুষ। আর এই আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ ধেয়ে আসার খবরে। এদিকে নদী তীরবর্তী বেড়িবাঁধের বাইরে ও কাছাকাছি বাসিন্দাদের আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে। করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসার খবরে সাধারণ মানুষের মধ্যে শঙ্কাও বিরাজ করছে। খুলনা পাউবো সূত্র জানায়, জেলায় ৮ শ’৭০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ২০ কিলোমিটার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে স্থানীয়দের মতে, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের দৈর্ঘ্য আরও বেশি হবে।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে খুলনার বিভিন্ন স্থানে সোমবার রাতে নামলো স্বস্তির বৃষ্টি। এতে টানা তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করতে থাকা মানুষের মাঝে স্বস্তি নেমে এসেছে। সোমবার (২৪ মে) রাত ৮টার দিকে হালকা বাতাসের সাথে বৃষ্টি শুরু হয়। যা থেমে থেমে রাত বারোটা পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। তবে বৃষ্টির সঙ্গে কোথাও কোথাও বজ্রপাতও হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ ধেয়ে আসার খবরে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন ‘আম্পান’ বিধ্বস্ত খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপসহ উপকূলবাসী। নদ তীরবর্তী বেড়িবাঁধের বাইরে ও বাঁধের কাছাকাছি বাসিন্দারা আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যে ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসার খবরে সাধারণ মানুষের মধ্যে শঙ্কা বিরাজ করছে।

খুলনা আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ মো. আমিরুল আজাদ বলেন, বঙ্গোপসাগরে থাকা ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে খুলনায় বৃষ্টি হচ্ছে। যা আগামীকাল ও পরশু অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, মোংলা সমুদ্র বন্দরকে ২ (দুই) নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

সূত্রে জানা যায়, প্রায় প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে বেড়িবাঁধ ভাঙনে খুলনার উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়। লবণাক্ত পানির কারণে এ এলাকার অবকাঠামো তথা রাস্তা ঘাটের ক্ষতিসাধন হয়, নষ্ট হয় ঘরবাড়ি, ফসল। ঘূর্ণিঝড় আসলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ গাছপালা, আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন কয়েক হাজার বাসিন্দা।

উপকূলের বাসিন্দাদের অভিযোগ, ঘূর্ণিঝড় বিধস্ত খুলনাঞ্চলের উপকূলে দীর্ঘদিন মেরামত না হওয়ায় অধিকাংশ বাঁধের বেহাল দশা। জোয়ার একটু বেশি হলেই বাঁধ ছাপিয়ে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করলেও সঠিক তদারকি নেই কর্তৃপক্ষের। প্রায় প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসের আঘাতে উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। একটির ক্ষত পুষিয়ে উঠতে না উঠতেই আবার নতুন আঘাত হানে তাদের ওপরে অন্য কোন ঘূর্ণিঝড়।

খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, খুলনা ২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। তবে কয়রা পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার আওতাধীন নয়, ঝুঁকিপূর্ণ এ উপজেলাটি সাতক্ষীরা পাউবোর অধীন। তিনি আরও জানান, ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ মোকাবিলায় পাঁচ হাজার জিও ব্যাগ ও সিনথেটিক ব্যাগ মজুদ রয়েছে।

এদিকে  টানা ৫৯ দিন লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকার পর চালু করার সরকারি নির্দেশ হলেও ইয়াসের ঝুঁকি এড়াতে মালিক পক্ষ টার্মিনালে নৌযান বেঁধে রেখেছে। যাত্রীরা সকাল থেকে টার্মিনালে ভিড় করলেও কোন নৌযান গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছাড়েনি। দিনভর খুলনা টার্মিনালে বাঁধা ছিল দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটের একাধিক নৌযান। অলস সময় কাটায় এ সব নৌযানের শ্রমিক ও কর্মচারীরা।

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ইয়াসের দুর্ঘটনা এড়াতে খুলনা-মদিনাবাদ, খুলনা-নীলডুমুর, খুলনা-কুড়িকাহুনিয়া রুটে এমএল ফারিয়া সাদিয়া, এমএল আল মদিনা-১, এমএল ওয়াটার কিং ৮, এমএল মুহুয়ীনাফি ও এমএল মোহামাদী নামক লঞ্চ টার্মিনালে বাঁধা ছিল।

আইডাব্লিওটিএ, খুলনা নদী বন্দরের উপ-পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে দুুই নম্বর সর্তক সংকেত দেয়া হয়েছে। আগামীকাল রাত থেকে এ সংকেত বাড়তে পারে। দুর্ঘটনা এড়াতে মালিক পক্ষ তাদের লঞ্চ চলাচল বন্ধ রেখেছে।

এমএল ফারিয়া সাদিয়া লঞ্চের কর্মচারী আলমগীর চৌধুরী জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় যাত্রীদের জীবনকে গুরুত্ব দিয়ে সাধারণত লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকে, ইয়াস সৃষ্টি হওয়ার পর তার ব্যতিক্রম হয়নি। এদিকের ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের তাণ্ডবে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতেই পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্চের আওতাধীন ৮টি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ফরেস্ট অফিস বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ওই সকল অফিসে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে (৫০ জন) নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বন্ধ করে দেয়া ওই ৮টি অফিসের মধ্যে রয়েছে শরণখোলা রেঞ্জের, দুবলা, কোকিলমনি, শ্যালা, কচিখালী ও চরখালী টহলফাঁড়ি। আর চাঁদপাই রেঞ্জের মধ্যে রয়েছে, তাম্বুলবুনিয়া, জোংাড়া ও ঝাপসি টহল ফাঁড়ি।

পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ইয়াস  ২৬ মে (বুধবার) বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বিষয়টি মাথায় রেখে ইতোমধ্যেই সুন্দরবনের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জের ৮টি টহল ফাঁড়ি বন্ধের পাশাপাশি সেখানকার লোকজনকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এছাড়া সুন্দরবনের জেলে, বাওয়ালী ও মৌয়ালদের নিরাপদে সরে যেতে বলা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, প্রতিবারের মত এবারও সুন্দরবন বুক পেতে উপকূলবাসীদের রক্ষা করবেন ইনশাল্লাহ।

অপরদিকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ইয়াস খুলনা উপকূলে আঘাত হানলে উপকূলের মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য বিএমএ খুলনার পক্ষ থেকে কার্যকরী পরিষদ-এর সদস্য ডা. সোহানা সেলিম-এর নেতৃত্বে ১০ সদস্যের  মেডিকেল টিম দ্রুত সেবা  দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।

সাতক্ষীরা থেকে , ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সাতক্ষীরায় ঝড়ো হাওয়ার পাশাপাশি হচ্ছে বৃষ্টি। সুন্দরবন সংলগ্ন নদীগুলোতে স্বাভাবিকের তুলনায় ৩ থেকে ৪ ফুট পর্যন্ত পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ইয়াস আঘাত হানলে বেড়িবাঁধগুলো ভেঙে পানিতে সয়লাব হতে পারে উপকূলের জনপদ। এমনটাই আশঙ্কা করা হচ্ছে।

উপজেলা প্রশাসন, কোস্টগার্ড ও পুলিশ এবং বিজিবিসহ বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে মাইকে ঘোষণা দিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে আনা হচ্ছে। পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের বন বিভাগের আটটি টহল ফাঁড়ির সব সদস্যকে নিরাপদে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ১৪৫টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে লক্ষাধীক মানুষকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এর বাইরে বিপুল সংখ্যক মানুষ শঙ্কার মধ্যে তাদের ঘরবাড়ি আঁকড়ে ধরে থাকতে হচ্ছে। শ্যামনগর এলাকা পুরোপুরি বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে আশ্রয় কেন্দ্রগুলো।

মঙ্গলবার সকাল থেকে সুন্দরবন সংলগ্ন চুনা, খোলপেটুয়া, মাংলঞ্চ ও কপোতাক্ষ নদীতে পানি বৃদ্ধি পায়। নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।এদিকে উপকূলীয় এলাকার আকাশ গুমোট আকার ধারণ করে মাঝে মাঝে বৃষ্টি এবং দমকা হাওয়া বইছে।

উপকূল এলাকা আশাশুনির প্রতাপনগর, শ্রীউলা, আনুলিয়া, খাজরা এবং শ্যামনগরের পদ্মপুকুর, গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, আটুলিয়া, কৈখালি , ঈশ্বরীপুর, রমজাননগর, কাশিমারিসহ সুন্দরবন লাগোয়া মুন্সীগঞ্জ  হরিনগর এলাকায় মাইকিং করে জনগণকে সতর্ক করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ১৪৫টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। এর মধ্যে শ্যামনগর উপজেলার ১০৩টি আশ্রয়কেন্দ্রের ধারণ ক্ষমতা ৭৫ হাজার বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু জার গিফারি।

তিনি জানান, জেলায় দেড় হাজার স্কুল কলেজ মাদ্রাসাও আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। কোভিড পিরিয়ডে নিরাপত্তা বজায় রেখে তাদের খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হবে।

এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধগুলো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার বেড়িবাঁধের ৪০টি পয়েন্ট খারাপ অবস্থায় রয়েছে। পূর্ণিমার ভরাকাটাল ও পূর্নচন্দ গ্রহণের সময় ইয়াসের দাপটে জলোচ্ছ্বাসের আশংকা করছেন উপকূলবাসী।

জেলা সহকারী বন সংরক্ষক এমএ হাসান বলেন, ইয়াস আঘাত করলে এবং অস্বাভাবিক জলোচ্ছ্বাস হলে তাদের উদ্ধার করে আনার জন্য নৌযানের ব্যবস্থা রাখা  হয়েছে।

সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা জুলফিকার আলী জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস গতকাল সন্থাপর্যন্ত সাতক্ষীরা থেকে ৪৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ  পশ্চিমে ঘূর্ণিঝড়টি অবস্থান করছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬৪ কিলিমিটারের মধ্যে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ থেকে ১১৭ কিলোমিটার। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ৬.৬ মিলি মিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আজ ২৬ মার্চ ভোর নাগাদ উপকূলে আঘাত হানতে পারে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস।

সাতক্ষীরা শ্যানগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকার্তা আনম আবুজর গিফারী বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় আমাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি আছে। আমাদের চার হাজার স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছে। গত বছরের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী, গাবুরা, পদ্মপুকুর, কাশিমাড়ি, মুন্সীগঞ্জ ও আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর, শ্রীউলা ও আশাশুনি সদরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।এ অবস্থায় আবার ঘূর্ণিঝড়ের খবরে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা লক্ষ করা যাচ্ছে। আজ সকালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িষ্যা উপকূলে এটি আঘাত হানতে পারে।

ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এটি ঘণ্টা ৯ কিলোমিটার গতি নিয়ে এগোচ্ছে। খবরে বলা হয়েছে, বুধবার দুপুরে স্থলভাগে আছড়ে পড়ার সময় ইয়াসের গতিবেগ ১৫৫ থেকে ১৬৫ কিলোমিটার, সর্বোচ্চ ১৮৫ কিলোমিটার হতে পারে। এটি অতি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে ওড়িষ্যার এবং পশ্চিমবঙ্গের পারাদ্বীপ ও সাগর দ্বীপের বালেশ্বরের কাছ দিয়েই ইয়াস অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে।

এরই মধ্যে ঝড়টির প্রভাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় জেলাগুলোতে ঝোড়ো বাতাস বয়ে যাচ্ছে। খুলনা, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী এলাকার নিচু এলাকা এবং চরাঞ্চলগুলোতে জোয়ারের পানি প্রবেশ করেছে। সুন্দরবনের দুবলার চরসহ জেলে পল্লিগুলোর বেশির ভাগ এলাকা এরই মধ্যে ডুবে গেছে।

সংবাদদাতা জানিয়েছেন, বাগেরহাটে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে মঙ্গলবার সকাল থেকে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। জেলার সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকা মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলাসহ জেলার সকল উপজেলায় থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। জেলা প্রশাসন থেকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নত করা জেলার মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা, মোংলা ও রামপাল উপজেলার বাসিন্দারের মধ্যে এখনও পর্যন্ত আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার কোন আগ্রহ দেখা না গেলেও জোয়ারের পানিতে নদী ও খালের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এ ৪টি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

সকাল ৮টা থেকে শরণখোলার বলেশ্বর, মোরেলগঞ্জের পানগুছি, মোংলার পশুর, বাগেরহাটের ভৈরব, দড়াটানাসহ সকল নদীর পানি স্বাভাবিক জোয়ারের থেকে এক দেড়-ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন সময় গড়ানোর সাথে সাথে এই পানি আরও বৃদ্ধি পাবে। এ মধ্যে জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে মোরেলগঞ্জ উপজেলার পৌর এলাকাসহ সদর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে। তবে এ উপজেলার পানগুছি নদীর তীরে থাকা শানকিভাঙ্গা ও বদনী ভাঙ্গা গ্রামের বেড়িবাঁধ না থাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে স্থানীয় মানুষের মধ্যে। যে কারনে ঝড়ের প্রভাব শুরুর আগে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে এই দুই গ্রামের বাসিন্দারা।

মোরেলগঞ্জ সদর ইউনিয়নের গাবতলা গ্রামের সালেহা বেগম বলেন, “সকাল থাইক্কা, গাঙ্গের পানি বাড়তেছে। সহাল ১০টার দিকে, পানিতে মোগো বাড়ী-ঘর তলাই গেছে”।

একই গ্রামের জামাল ফজলু হাওলাদার বলেন, “জোয়ারে, গাঙ্গের পানি যে ভাবে বারতিছে তাকে দুপুরে আসতে আসতে মোগা ভাইসা যামু।

শরন খোলার বাসিন্দা রবিউল ইসলাম বলেন, “মোগো তো আর ঝড়ের প্রয়োজন হয় না। আমাবশ্য ও পূর্ণিমায় জোয়ারের পানিতে মোরা ডুইব্বা যাই। মোগো বাজারও তলাই যায়। তয় এবার পানির তোর একটু বেশি। সকাল থাইক্কা পানি উঠতে শুরু করছে”।

বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বজিৎ বৌদ্ধ বলেন, পূর্ণিমার ও ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কারণে উপকূলীয় এলাকায় নদী-খালের পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। দুপুর নাগাত এ পানি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ভাটিতে এ পানি আবার নেমে যাবে। মোরেলগঞ্জের কিছু গ্রামে রয়েছে যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন ভেড়িবাঁধ নেই। সে সব গ্রামের বাসিন্দারা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তাদেরকে নিরাপদে সাইক্লোন শেল্টারে যাওয়ার জন্য বলেন এ কর্মকর্তা।

এদিকে গত সন্ধ্যা থেকে সাগর প্রচন্ড উত্তাল হয়ে উঠায় এবং ঝড়ো বাতাস বয়ে যাওয়াতে সুন্দরবনের বিভিন্ন  সাইক্লোন শেল্টারসহ কোস্ট গার্ডের ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে বনবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। নতুন করে সিগনাল না বাড়ায় এবং আবহওয়া বেশি খারাপ না হওয়াতে মোংলা বন্দরে অবস্থানরত ১১টি বিদেশী জাহাজের পণ্য ওঠানামা ও পরিবহণের কাজ স্বাভাবিক রয়েছে।

বন্দরের হারবার মাস্টার কমান্ডার শেখ ফখরউদ্দীন বলেন, সিগনাল ৪ নম্বর না হওয়া পর্যন্ত বন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকবে। ৪ নম্বর সিগনাল জারি কিংবা ক্রস করলেই সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হবে। মঠবাড়িয়ায় ইয়াসের প্রভাবে বলেশ্বরের পানি বৃদ্ধিতে মাঝের চরের বেরি বাঁধ ২ জায়গায় নদীগর্ভে বিলিন ।

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এর প্রভাবে ৪/৫ ফুট পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বলেশ্বরের বুকে জেগে ওঠা মাঝের চরের বেড়িবাঁধে দুই জায়গা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এতে চরের প্রায় আড়াইশ পরিবার আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। চরের বাসিন্দা ও সিপিপি সদস্য আব্দুল হালিম জানান-আজ মঙ্গলবার সকালে বলেশ্বরের জোয়ারের স্রোতে চরের পশ্চিম দিকে মোতালেব হাওলাদারের বাড়ি সংলগ্ন বাধের ২০/২৫ ফুট ও দক্ষিণ দিকের সদ্য মেরামত করা বাঁধের আঃ কাদেরের বাড়ি সংলগ্ন ২৫/৩০ ফুট চর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বাঁধের দুই জায়গায় ভাঙ্গনের ফলে জোয়ারের পানি বুধবার আরও বৃদ্ধির আশংকায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে চরের লোকজন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উর্মি ভৌমিক জানান-বলেশ্বরের জোয়ারের স্রোতে মাঝের চড়ের বেড়িবাঁধ ভাঙনের বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে চরবাসীকে নিরাপদ আশ্রয়ে আনার যানবাহন প্রস্তুত আছে। তিনি আরও জানান, ইতিমধ্যে এ ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় উপজেলার একটি পৌর শহর ও ১১ ইউনিয়নের ৭৫টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সাইক্লোন শেল্টারে আশ্্রয় নেয়া মানুষদের জন্য শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। উপজেলা দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাকরে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে বলে ইউএনও উর্মি ভৌমিক জানান।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ভোলার মনপুরায় বাধ ভেঙে এবং জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে ১৫টি গ্রাম। এতে চর কুকরি-মুকরি, ঢালচর, চর পাতলাসহ আশেপাশের ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে খাবার পানি সংকট।

মোংলায় মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকেই দেখা দিয়েছে ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টিপাত। সেই সাথে সাগর ও পশুর চ্যানেল বেশ উত্তাল থাকায় সুন্দরবনর সংলগ্ন এলাকার সব জেলেকে দ্রুত নিরাপদে সরিয়ে নিতে মাইকিং করছে কোস্টগার্ড।

পটুয়াখালীতে জোয়ারের তোড়ে কলাপাড়ার লালুয়া এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ ভেঙে ৯টি গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় পানিবন্দি ৮ হাজার মানুষ বলে জানা গেছে। উত্তাল সাগরের ঢেউয়ের তোড়ে কুয়াকাটা সৈকতের অর্ধশতাধিক অস্থায়ী দোকানপাট ভেসে গেছে। এ অবস্থায় জানমাল রক্ষায় মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে সতর্কতামূলক মাইকিং করছে প্রশাসন।

সর্বশেষ আপডেট: ২৬ মে ২০২১, ০১:০০
মুক্তিবাণী

পাঠকের মন্তব্য

ফেসবুকে

সর্বশেষ আপডেট

ভিডিও