“সে তো কুত্তার বাচ্চা!”, “ওটা শুয়োরের বাচ্চার মত কাজ করেছে!” – অফিসের করিডরে, আড্ডায়, ফোনালাপে, এমনকি সামাজিক মাধ্যমেও এ ধরনের কটূক্তি ও গীবত (পরনিন্দা) আজ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। অন্যের অনুপস্থিতিতে তার চরিত্র, বংশ বা কাজকে হেয় করার এই সংস্কৃতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষ ছড়াচ্ছে। শুধু সামাজিক সম্পর্কই নয়, ব্যক্তির আত্মিক ও নৈতিক ভিতকেও করছে নড়বড়ে। ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এই গীবত ও অপবাদ দেওয়া কতটা মারাত্মক গুনাহ? এটি আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও আখিরাতে কী পরিমাণ ক্ষতি ডেকে আনে? আর এই বিষবৃক্ষ থেকে উত্তরণের ইসলামিক উপায়ই বা কী? চলুন জেনে নিই কুরআন-হাদিসের আলোকে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি।
(ইসলামিক দৃষ্টিতে গীবতের সংজ্ঞা ও ভয়াবহতা - কুরআন-হাদিসের রেফারেন্স সহ):
1. গীবত কী? ইসলামে গীবতের সংজ্ঞা অত্যন্ত স্পষ্ট। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন:
> “গীবত হলো, তুমি তোমার ভাইয়ের এমন কথা উল্লেখ কর, যা শুনলে সে অপছন্দ করবে।” (জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন) “যদি তার মধ্যে (তুমি যা বলছ) তা থাকে, তাহলে তা গীবত; আর যদি না থাকে, তাহলে তা তো তাহার উপর মিথ্যা অপবাদ।” (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ২৫৮৯)
সুতরাং, “কুত্তার বাচ্চা”, “শুয়োরের বাচ্চা” ইত্যাদি বলা শুধু গীবত নয়, এটি মারাত্মক পর্যায়ের অপবাদ (বুহতান) ও অভিশাপ প্রদান, যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
2. কুরআনের কঠোর নিষেধাজ্ঞা:
• সূরা আল-হুজুরাত (৪৯:১২): “হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিকাংশ অনুমান থেকে দূরে থাক। নিশ্চয় কিছু অনুমান পাপ। আর গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না (তাজাসুস করো না) এবং একে অপরের গীবত করো না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে? বস্তুতঃ তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।”
• (এখানে গীবতকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে, যা গীবতের জঘন্যতা ও নৃশংসতা ফুটিয়ে তোলে।)
• সূরা আল-হুমাজাহ (১০৪:১): “ধ্বংস সেই প্রত্যেকের জন্য, যে পশ্চাতে ও সম্মুখে পরনিন্দা করে।”
• (পরনিন্দাকারীদের জন্য কঠোর সতর্কবাণী।)
3. হাদিসে ভয়াবহ পরিণতির বর্ণনা:
• রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন: “মিরাজের রাতে আমি এমন এক সম্প্রদায়ের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলাম যাদের নখ ছিল তামার তৈরি। তারা তা দিয়ে নিজেদের মুখমণ্ডল ও বক্ষদেশ আচড়াচ্ছিল। আমি জিবরাঈল (আ.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? তিনি বললেন, এরা সে সমস্ত লোক যারা মানুষের গোশত ভক্ষণ (গীবত) করত এবং তাদের ইজ্জত-আব্রুর উপর হামলা করত।” (সুনান আবু দাউদ, হাদিস নং ৪৮৭৮ - হাদিসটি হাসান)
• অন্য হাদিসে এসেছে: “মানুষের সম্পদ, রক্ত ও ইজ্জত-সম্মান অন্য মানুষের উপর হারাম (অলঙ্ঘনীয়)।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ৬৮৬২; সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ২৫৬৪)
(গীবত ও অপবাদের ক্ষতিকর দিক - ইসলামিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ):
1. আত্মিক ক্ষতি (সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ):
• এটি “কবীরা গুনাহ” (মহাপাপ)।
• আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও শাস্তির কারণ। (সূরা হুমাজাহ দেখুন)
• গীবতকারীর নেক আমল ধ্বংস হয়। রাসূল (সা.) বলেছেন: “ফাসেক ব্যক্তির গীবত করলে তোমার নেকী তার কাছে চলে যায়। আর তুমি যে বিষয়ে অপবাদ দিয়েছ, তা যদি তার মধ্যে না থাকে, তাহলে তার পাপ তোমার উপর চলে আসে।” (সুনান আত-তিরমিযী, হাদিস নং ২০৩২ - হাদিসটি হাসান)
• আত্মশুদ্ধির পথে বাধা সৃষ্টি করে।
2. সামাজিক ক্ষতি:
• পারস্পরিক বিশ্বাস, ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্ববোধ ধ্বংস হয়।
• কলহ-বিবাদ, শত্রুতা ও বিভাজনের সৃষ্টি করে।
• সমাজে বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি হয়, সহযোগিতা কমে যায়।
• ব্যক্তির সম্মান ও সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়।
3. ব্যক্তিত্বের ক্ষতি (গীবতকারীর):
• গীবতকারী অহংকার, হিংসা ও নীচু মানসিকতার শিকার হয়।
• তার চারিত্রিক দুর্বলতা প্রকাশ পায়।
• নিজের ভুলত্রুটির প্রতি অন্ধ হয়ে যায়, অন্যদের দোষ খুঁজতে ব্যস্ত থাকে।
(গীবত থেকে উত্তরণের ইসলামিক পথ - কুরআন-হাদিস ও আলেমদের দৃষ্টিভঙ্গি):
1. আল্লাহর ভয় (তাকওয়া) ও জবাবদিহিতার অনুভূতি জাগ্রত করা: সর্বদা স্মরণ রাখা যে আল্লাহ সব শুনছেন ও দেখছেন। গীবতের কঠোর শাস্তি আছে। (সূরা হুজুরাত:১২, সূরা হুমাজাহ:১)
2. তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা: অতীতের গীবতের জন্য আন্তরিকভাবে তওবা করা এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া। গীবতের শিকার ব্যক্তির কাছেও ক্ষমা চাওয়া প্রয়োজন, যদি তা তার কাছে পৌঁছার সম্ভাবনা থাকে এবং তা থেকে নতুন ফিতনা সৃষ্টির আশঙ্কা না থাকে। (ইমাম গাজালী, ইহইয়া উলুমিদ্দীন - গীবত অধ্যায়)
3. নিজের জবান নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা: কথা বলার আগে ভাবা – “এই কথাটি কি গীবত হবে?”, “এটা বললে আমার ভাই/বোনের ক্ষতি হবে?”, “এটা শুনলে সে কষ্ট পাবে?”। রাসূল (সা.) বলেছেন: “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে, নতুবা চুপ থাকে।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ৬৪৭৫; সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ৪৭)
4. নেগেটিভ পরিবেশ এড়িয়ে চলা: যে সভা, আড্ডা বা গ্রুপে গীবত-পরনিন্দা হয়, সেখান থেকে দূরে থাকা বা বের হয়ে আসা। রাসূল (সা.) বলেছেন: “যে ব্যক্তি গীবত শুনে তার ভাইকে সাহায্য করবে (বাধা দেবে), আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তাকে সাহায্য করবেন।” (শরহুস সুন্নাহ লিল বাগাবী)
5. ইতিবাচক কথাবার্তা ও ভালো গুণ প্রচার: অন্যের ভালো গুণ, সাফল্য ও ইতিবাচক দিক তুলে ধরা। গীবতের পরিবর্তে সুপারিশ, সাহায্য বা ভালো পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করা।
6. নিজের ভুলত্রুটির প্রতি দৃষ্টি দেওয়া: অন্যের দোষ খোঁজার আগে নিজের দোষ দেখার চেষ্টা করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “তোমরা কি মানুষকে ভাল কাজের আদেশ দাও এবং নিজেরা নিজেদেরকে ভুলে যাও? অথচ তোমরা কিতাব পাঠ কর? তবুও কি তোমরা বুঝবে না?” (সূরা আল-বাকারাহ, ২:৪৪)
7. দোয়া ও ধৈর্য: গীবতের খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করতে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া এবং ধৈর্য ধারণ করা। এটা একটি জিহাদ।
(কনক্লুশন - আহ্বান): “কুত্তার বাচ্চা”, “শুয়োরের বাচ্চা” – এই শব্দগুলো শুধু কটূক্তি নয়; এগুলো আমাদের সমাজের মেরুদণ্ডে লাগানো বিষাক্ত ছুরি। ইসলাম একে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সমতুল্য ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই অভ্যাস ব্যক্তিকে আখিরাতের শাস্তির মুখোমুখি করে তোলে, সমাজে ছড়ায় বিভক্তি ও বিষ। কিন্তু হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কুরআন-সুন্নাহ আমাদেরকে গীবতের এই নিকৃষ্ট অভ্যাস থেকে বের হয়ে আসার সুনির্দিষ্ট পথ দেখিয়েছে: তাকওয়া, জবানের হিফাজত, তওবা, নেগেটিভ পরিবেশ বর্জন এবং অন্যের ভালো দিক অনুসন্ধান। আসুন, আমরা নিজেদের জবানের দায়িত্ব বুঝি। অন্যের অনুপস্থিতিতে তার সম্মান রক্ষার চেষ্টা করি। কথায় কথায় গীবতের পরিবর্তে সুন্দর কথা, উপকারী পরামর্শ ও ইতিবাচক আলোচনাকে স্থান দিই। তবেই আমরা একটি সুস্থ, সুন্দর ও আল্লাহর রহমতপুষ্ট সমাজ গড়ে তুলতে পারব। গীবতমুক্ত জীবনই হলো প্রকৃত মুসলিম জীবনের অন্যতম নিদর্শন। নিজেকে এবং সমাজকে এই জঘন্য অভ্যাস থেকে মুক্ত করার আজই সময়।
পাঠকের মন্তব্য