ভূমিকা: মহররম মাসের ১০ তারিখ, পবিত্র আশুরা। এটি ইসলামের ইতিহাসে এক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ দিন। হযরত মুসা (আ.) ও বনি ইসরাঈলের ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি, নূহ (আ.)-এর নৌকা স্থলভাগে অবতরণ এবং কারবালার মর্মান্তিক শাহাদাতের স্মৃতি বহন করে এই দিনটি। সুন্নী মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য আশুরা হলো ইবাদত, চিন্তা ও সংযমের দিন। কুরআন ও সহীহ হাদীসের নির্দেশনা অনুযায়ী এই দিনটির পবিত্রতা রক্ষা করে আমল করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে মহান আল্লাহর রহমত ও বিশেষ কল্যাণ। চলুন জেনে নিই, আশুরা উপলক্ষে সুন্নী মুসলমানের করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়াবলী।
করণীয় (কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে):
(১). রোজা পালন (সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল):
* হাদীস: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, “আমি আশা করি, আশুরার রোজার কারণে আল্লাহ অতীতের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ মাফ করে দেবেন।” (সহীহ মুসলিম, ১১৬২)। তিনি নিজে এই দিনে রোজা রাখতেন এবং সাহাবাদেরও নির্দেশ দিতেন (সহীহ বুখারী, ২০০৪; সহীহ মুসলিম, ১১৩০)।
* পদ্ধতি: শুধু ১০ই মহররম রোজা রাখা উত্তম। তবে শুধু ইহুদিদের সাদৃশ্য পরিহার করতে ৯ অথবা ১০ ও ১১ মহররম (অর্থাৎ ৯+১০ বা ১০+১১) রোজা রাখা আরও বেশি মুস্তাহাব (সুন্নাত সম্মত)। (সহীহ মুসলিম, ১১৩৪; সুনান আবু দাউদ, ২৪৪৫)।
* উপকারিতা: অতীতের এক বছরের গুনাহ মোচনের আশা, আল্লাহর নৈকট্য লাভ, আত্মসংযম ও তাকওয়া বৃদ্ধি।
(২). তওবা ও ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা):
* কুরআন: “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো- খাঁটি তওবা।” (সূরা আত-তাহরীম, ৬৬:৮)। আশুরা তওবার একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়।
* উপকারিতা: আত্মশুদ্ধি, আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা লাভের সুযোগ বৃদ্ধি।
(৩). দান-সদকা করা:
* হাদীস: রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “সদকা কবীরা গুনাহকে এমনভাবে মিটিয়ে দেয়, যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়।” (সুনান তিরমিযী, ৬১৪; সহীহ ইবনে হিব্বান)। এই দিনে দান-খয়রাতের ফজিলত অপরিসীম।
* উপকারিতা: রিজিকে বরকত, বিপদ-আপদ দূরীভূত হওয়া, গুনাহ মোচন ও সমাজে কল্যাণ ছড়ানো।
(৪).পরিবার-পরিজনের জন্য প্রাচুর্যের ব্যবস্থা করা:
* হাদীস: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি আশুরার দিনে নিজ পরিবার-পরিজনের জন্য প্রাচুর্য (খানা-পিনা) এর ব্যবস্থা করবে, আল্লাহ তাকে সারা বছর প্রাচুর্য দান করবেন।” (শু’আবুল ঈমান, বাইহাকী - কিছু আলেম একে হাসান পর্যায়ের বলেছেন, তবে এর অর্থ হলো সাধারণ দানশীলতা ও উদারতা প্রদর্শন)।
* ব্যাখ্যা: এটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত এবং ভালো কাজের উৎসাহ দানকারী আমল। এর অর্থ কেবল খাবার নয়, পরিবারের প্রতি যত্নবান হওয়া ও তাদের সুখ-সুবিধার ব্যবস্থা করা।
* উপকারিতা: পারিবারিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি, রিজিকে বরকত ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।
(৫). নবী মুসা (আ.) ও কারবালার শহীদদের স্মরণ, শিক্ষা গ্রহণ ও দুআ:
* কুরআন: মুসা (আ.)-এর মুক্তির ঘটনা উল্লেখ (সূরা ত্ব-হা: ৭৭-৭৯; সূরা আশ-শু’আরা: ৬৩-৬৭)। কারবালার ঘটনা থেকে ঈমানের দৃঢ়তা, সত্যের জন্য সংগ্রাম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শিক্ষা গ্রহণ।
* আমল: কুরআন তিলাওয়াত, নবীদের কাহিনী অধ্যয়ন, ইমাম হুসাইন (রা.) ও তাঁর সঙ্গীদের জন্য দুআ ও তাদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন (কোনো প্রকার শোক অনুষ্ঠান নয়, বরং শিক্ষা গ্রহণ)।
* উপকারিতা: ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি, ধৈর্য ও তাকওয়ার শিক্ষা, ইতিহাস থেকে হিকমত অর্জন।
বর্জনীয় (কুরআন ও সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে):
(১). শোক পালনের নামে বিলাপ, মাতম, বুক চাপড়ানো, চিৎকার করা:
* হাদীস: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মুখে চাপড়ায়, জামা ছিঁড়ে এবং জাহেলী যুগের ডাক ডাকে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।” (সহীহ বুখারী, ১২৯৪; সহীহ মুসলিম, ১০৩)। কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা সত্ত্বেও সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণ এমন কোনো আমল করেননি।
* কারণ: এগুলো জাহেলী যুগের প্রথা, ধৈর্য ও ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী।
(২). শরীরকে রক্তাক্ত করা, শোক প্রকাশে তাজিয়া/জুলজুস বা আত্মপীড়ন:
* কুরআন: “নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপর কোনো সংকট চাপিয়ে দেন না।” (সূরা আল-বাকারাহ, ২:২৮৬)। “তোমরা নিজেদের হাতে নিজেদের ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ কোরো না।” (সূরা আল-বাকারাহ, ২:১৯৫)।
* হাদীস: উল্লিখিত হাদীস (সহীহ বুখারী, ১২৯৪) এ ধরণের কর্মকে নিষিদ্ধ করে।
* কারণ: ইসলাম ধৈর্য, সংযম ও বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার শিক্ষা দেয়। আত্মপীড়ন কোনো সমাধান নয়।
(৩). ইমাম হুসাইন (রা.) বা কারবালাকে কেন্দ্র করে বাড়াবাড়ি, গালাগালি বা বিদ্বেষ ছড়ানো:
* কুরআন: “মুমিনগণ তো পরস্পর ভাই ভাই।” (সূরা আল-হুজুরাত, ৪৯:১০)। “অন্যের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করো না…” (সহীহ বুখারী, ৬০৬৫)।
* কারণ: এতে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য বিনষ্ট হয়, বিভেদ ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। ইসলাম ভ্রাতৃত্ব ও শান্তির শিক্ষা দেয়।
(৪). ভিত্তিহীন কিচ্ছা (কাহিনী), মিথ্যা ঘটনা বা অতিরঞ্জিত বর্ণনা প্রচার:
* হাদীস: রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার উপর মিথ্যা আরোপ করে, সে তার ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নিক।” (সহীহ বুখারী, ১১০)।
* কারণ: ইতিহাস বিকৃত করা, মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা এবং ধর্মে বিদআতের জন্ম দেয়।
(৫).অন্যায়ভাবে এই দিনকে “অমঙ্গলজনক” বা “অশুভ” মনে করা:
* কুরআন ও হাদীস: ইসলামে অশুভ দিনের কোনো ধারণা নেই। ভাগ্য আল্লাহর হাতে। রাসূল (ﷺ) এই দিনে রোজা রেখেছেন এবং উৎসাহিত করেছেন, যা এর কল্যাণময়তাই প্রমাণ করে।
আশুরার আমলের সার্বিক উপকারিতা:
* আত্মশুদ্ধি: রোজা, তওবা ও ইস্তিগফারের মাধ্যমে গুনাহ মোচন ও আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা।
* আল্লাহর নৈকট্য: বিশেষ ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রহমত লাভ।
* ঐতিহাসিক সচেতনতা: মুক্তির শিক্ষা (মুসা আ.) ও ঈমানী দৃঢ়তার শিক্ষা (কারবালা) গ্রহণ।
* ধৈর্য ও তাকওয়া প্রশিক্ষণ: সংযম পালন, ভোগবিলাস পরিহার ও আল্লাহভীতির অনুশীলন।
* সামাজিক সম্প্রীতি: দান-সদকা, পরিবারের প্রতি যত্নশীলতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করা।
* রিজিকে বরকত: দানশীলতা ও পরিবারের জন্য প্রাচুর্যের ব্যবস্থার প্রতিদান।
* বিদআত থেকে হিফাজত: শোক পালনের নামে শরীয়ত বহির্ভূত কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা।
উপসংহার: পবিত্র আশুরা সুন্নী মুসলমানের জন্য আল্লাহর রহমত লাভের এক সুবর্ণ সুযোগ। কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে সঠিক আমল- যেমন রোজা রাখা, তওবা-ইস্তিগফার করা, দান-সদকা করা, পরিবারের প্রতি যত্নবান হওয়া এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করাই হলো এই দিনের মূল দাবি। অন্যদিকে, শোক পালনের নামে শরীয়তবিরোধী সকল কর্মকাণ্ড (বিলাপ, মাতম, আত্মপীড়ন, বিদ্বেষ ছড়ানো) পরিত্যাগ করা অপরিহার্য। আসুন, আমরা এই পবিত্র দিনের মর্যাদা রক্ষা করে তার প্রকৃত শিক্ষা ও কল্যাণ লাভ করি। নিজেদের আমলকে শুদ্ধ করি এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করি। এই দিনের মাধ্যমে আমাদের জীবনে আসুক শান্তি, সমৃদ্ধি ও আল্লাহর অফুরন্ত রহমত।
দোয়া: “হে আল্লাহ! আপনি আমাদের মহররম মাসের বরকত দান করুন। আশুরার দিনের রোজা ও আমলগুলো আমাদের জন্য কবুল করুন। আমাদের অতীতের গুনাহগুলো ক্ষমা করে দিন। আমাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করুন এবং সঠিক পথে অবিচল রাখুন। কারবালার শহীদদের ঈমানী দৃঢ়তার ন্যায় দৃঢ়তা আমাদের দান করুন। আমীন।”
পাঠকের মন্তব্য