মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের ফুলবাড়ি গ্রামের পতিত জমিগুলো আজ সোনালি সাফল্যে ভরপুর। উচ্চ ফলনশীল নতুন জাতের কলা চাষে অভাবনীয় সাফল্য আর লাভের মুখ দেখছেন এখানকার কৃষক-কৃষাণীরা। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)-এর আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় এবং হীড বাংলাদেশ-এর সরাসরি বাস্তবায়নে কৃষি ইউনিট (ফসল খাত)-এর এই উদ্যোগ গ্রামটিতে এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে।
সমিতির সদস্যদের সফল গল্প: হীড বাংলাদেশ-এর মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচির আওতাধীন কমলগঞ্জ শাখার বিভিন্ন সমিতির সদস্যরাই এই সাফল্যের নায়ক। সোনালি, দোয়েল, লতা, শিউলী (মহিলা) ও রঙ্গিলা (পুরুষ) সমিতির সদস্যরা জি-৯ ও সাগর জাতের এই কলা চাষে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
মনির হোসেনের (লতা সমিতি) কথায়: “২০২৩-২৪ অর্থবছরে হীড বাংলাদেশের কাছ থেকে কলা চারা, জৈব ও রাসায়নিক সার, বালাইনাশক আর আর্থিক অনুদান পেয়ে শুরু করি নতুন এই কলার চাষ। মাত্র ২৫ শতাংশ পতিত জমিতে খরচ হয়েছে ১০-১২ হাজার টাকা। কিন্তু এ পর্যন্ত কলা বিক্রি করেই পেয়েছি ৬০-৭০ হাজার টাকা! হীড বাংলাদেশের কৃষি কর্মকর্তা সোহেল সিকদার ভাইয়ের পরামর্শ ঠিকমতো মেনে চলায় এই ফল পেয়েছি।”
লাল মিয়ার (লতা সমিতি) অভিজ্ঞতা: “আমি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে হীড বাংলাদেশের সহযোগিতায় ২০ শতাংশ পতিত জমিতে জি-৯ কলা লাগিয়েছি। এই জাতটা রোগ প্রতিরোধী, দেখে অন্যরাও এখন আগ্রহী হচ্ছেন। সবাইকে এই কলা চাষে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই। কৃষি কর্মকর্তার উপদেশ আর হীডের আর্থিক সহায়তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।”
কারিগরি দিক: কেন জি-৯ এত লাভজনক? কমলগঞ্জ উপজেলার হীড বাংলাদেশ কৃষি ইউনিটের কৃষি কর্মকর্তা সোহেল সিকদার জি-৯ কলার অসাধারণ গুণাবলীর কথা তুলে ধরেন:
“জি-৯ কলা গাছ রোপণের মাত্র ১১ থেকে ১৫ মাসের মধ্যেই ফল দিতে শুরু করে। কলাগুলো আকারে বেশ বড়, ফলনও অত্যন্ত চমৎকার। সবচেয়ে বড় কথা, এটি একটি রোগ প্রতিরোধী জাত। একটা গাছেই প্রায় ২২০ থেকে ২৪০টি পর্যন্ত কলা ধরে। আর একবার চারা লাগালে পরবর্তী ৩ থেকে ৪ বছর ধরে টানা ফলন পাওয়া যায়। খরচ কম, ফলন বেশি, রোগের ঝুঁকি কম – সব মিলিয়ে এই কলা চাষে কৃষক ভাইয়েরা নিশ্চিতভাবে অনেক বেশি লাভবান হবেন।”
কৃষি দপ্তরের সমর্থন ও কলার পুষ্টিগুণ: কমলগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জনাব জয়ন্ত কুমার রায় এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন: “জি-৯ কলার চারা টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে উৎপাদিত হয়, যার ফলে এটি একটি রোগমুক্ত ও উচ্চ ফলনশীল জাত। কলা শুধু লাভের ফসলই নয়, এটি একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর ফল। কলা শক্তি বাড়ায়, হজমশক্তি উন্নত করে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে এবং নানাবিধ ভিটামিন ও খনিজের চমৎকার উৎস। হীড বাংলাদেশ ও পিকেএসএফের এই কার্যক্রম অত্যন্ত প্রশংসনীয়। ভবিষ্যতে কৃষি সংক্রান্ত যেকোনো সহযোগিতার প্রয়োজনে উপজেলা কৃষি দপ্তর সর্বদা প্রস্তুত।”
সফলতার নেপথ্যে: হীড বাংলাদেশ কমলগঞ্জ শাখা, তাদের কৃষি ইউনিট এবং পিকেএসএফ-এর সমন্বিত প্রচেষ্টাই এই সাফল্যের মূল চালিকাশক্তি। কৃষকদেরকে উচ্চমানের চারা, জৈব ও রাসায়নিক সার, বালাইনাশক সরবরাহ করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় আর্থিক অনুদান এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে নিবিড় কারিগরি পরামর্শ ও মাঠ পর্যায়ের নিয়মিত মনিটরিং এই সাফল্য এনে দিয়েছে। বিশেষ করে কৃষি কর্মকর্তা সোহেল সিকদারের হাত ধরেই কৃষকরা আধুনিক কলা চাষের কলাকৌশল রপ্ত করেছেন।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা: ফুলবাড়ি গ্রামের সাফল্য এখন আশেপাশের গ্রামগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে। লাল মিয়ার ভাষায়, রোগ প্রতিরোধী এই জাত দেখে অন্যরাও আগ্রহী হচ্ছেন। হীড বাংলাদেশের এই মডেল, যেখানে আর্থিক সহায়তা, মানসম্মত উপকরণ সরবরাহ এবং বিজ্ঞানসম্মত কারিগরি জ্ঞানের মেলবন্ধন ঘটেছে, তা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের পতিত জমি কাজে লাগানো এবং কৃষকের আয় বাড়ানোর জন্য একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। ফুলবাড়ির এই ‘সোনালি ফসল’ শুধু কৃষকের ঘরই আলো করছে না, দেশের কৃষি অর্থনীতিতেও যোগ করছে নতুন মাত্রা।
পাঠকের মন্তব্য