স্বার্থপরতার ছোবলে ফাটল ধরা সমাজ: উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে এখনই

ছবি মুক্তিবাণী
ছবি মুক্তিবাণী
মনিরুজ্জামান মনির

“আমারটা হলেই হল!”—এই ব্যক্তিস্বার্থবাদী মন্ত্র আজকের বিশ্ববাসীর অধিকাংশের অজান্তে বা অনিচ্ছাকৃত জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তির স্বার্থকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে সফলতার সূচক হিসেবে, কিন্তু এই আত্মকেন্দ্রিকতার বিষবাষ্প কীভাবে সমাজের শিরা-উপশিরায় বিষক্রিয়া করছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভয়াবহ ক্ষতচিহ্ন রেখে যাচ্ছে?

বিশ্বজুড়ে যেমন দারিদ্র্য, পরিবেশ সংকট ও সামাজিক ভঙ্গুরতা বাড়ছে, তেমনি এ বিষয়গুলোতে স্বার্থপরতার অবদান অনস্বীকার্য। আজকের প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করবো কীভাবে এই স্বার্থপরতা আমাদের সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং কোন পথে উত্তরণের সম্ভাবনা রয়েছে।

স্বার্থপরতার বিষাক্ত ছোবল: সমাজে ক্ষতির বিশ্লেষণ

১. সামাজিক সংহতি ক্ষয়প্রাপ্ত: আমরা প্রায়ই দেখি—পরিবেশকর্মীদের সাহায্যের হাত না বাড়ানো, দুর্যোগে প্রতিবেশীর প্রতি উদাসীনতা, গণপরিবহনে প্রবীণদের জন্য সিট ছাড়তে অনীহা ইত্যাদি।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা (Harvard Study of Adult Development, 80+ বছর) স্পষ্ট করেছে, ব্যক্তিগত সুখ ও দীর্ঘায়ু মূলত সামাজিক সম্পর্ক ও সংযোগের উপর নির্ভরশীল। স্বার্থপরতা এই সংযোগকে ক্ষুণ্ন করে সমাজকে ভাঙনের দিকে নিয়ে যায়।

২. সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসমতা বৃদ্ধি: কর্পোরেট লোভের শিকার হয়ে বহু পরিবেশ দূষণ, শ্রমিক শোষণ ও সম্পদের একনিবেশ ঘটছে।

অক্সফাম (Oxfam, 2023) রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের শীর্ষ ১% ধনী লোকের হাতে রয়েছে বৈশ্বিক সম্পদের প্রায় ৬৫%, যেখানে প্রায় ১৭ কোটি মানুষ দারিদ্র্যের চরম সীমায় বসবাস করছে। এই অভিজাতকরণের পেছনে রয়েছে স্বার্থপর নীতি ও আচরণ।

৩. বিশ্বব্যাপী সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতা: জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে যৌথ উদ্যোগে অবহেলা, ভ্যাকসিন বণ্টনে বৈষম্য—সবই স্বার্থপরতার ফল। জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনগুলোতে ধনী দেশগুলো প্রয়োজনীয় তহবিল প্রদান করছে না, যার কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞ মতামত: ডঃ আন্থনি গেটস, পরিবেশ বিজ্ঞানী বলেন, “স্বার্থপরতা শুধুমাত্র পরিবেশগত ধ্বংসের কারণ নয়, এটি সামাজিক অবিচার ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের মূল চালিকা শক্তি।”

৪. অবিশ্বাস ও হিংস্রতার বীজ বপণ: স্বার্থপরতা ব্যক্তির মধ্যেকার অবিশ্বাস ও প্রতিযোগিতাকে বাড়িয়ে দেয়। পরিবারের মধ্যে সম্পত্তি বিরোধ, সহকর্মীদের সাথে শত্রুতা এবং সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়।

সাইকোলজি জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, স্বার্থপর আচরণ মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও অবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়, যা সমাজে দ্বন্দ্ব ও হিংসার মাত্রা বাড়ায়।

৫. মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়: দান-খয়রাত ও স্বেচ্ছাসেবায় হ্রাস, শিল্প-সাহিত্যে মানবিকতার অবমূল্যায়ন সমাজে মানবিকতা কমিয়ে দেয়।

বিশ্বব্যাপী ‘চারিটি এইড ফাউন্ডেশন’ (CAF World Giving Index) প্রতিবেদনে দেখা যায়, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময়ে দানের প্রবণতা নাটকীয়ভাবে কমে যায়, যা আত্মরক্ষামূলক স্বার্থপরতার বহিঃপ্রকাশ।

স্বার্থপরতার বন্ধন ভাঙার পথ: সমাধানের সূত্র

১. মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষায় গুরুত্ব বৃদ্ধি: স্কুল ও কলেজের পাঠ্যক্রমে ‘সহমর্মিতা’, ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা’ এবং ‘নৈতিকতা’ শেখানো জরুরি।

উদাহরণ: ফিনল্যান্ড ও নরওয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় এম্প্যাথি ও সামাজিক শিক্ষাকে পাঠ্যক্রমের প্রধান অংশ হিসেবে রাখা হয়েছে, যা সামাজিক সংহতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।

২. সহযোগিতামূলক অর্থনৈতিক মডেল প্রসার: সমবায় ভিত্তিক ব্যবসা, সামাজিক উদ্যোগ ও কমিউনিটি সাপোর্টেড এগ্রিকালচার (CSA) মডেলকে উৎসাহিত করতে হবে।

বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংক মডেল দেখিয়েছে, ক্ষুদ্রঋণ ও সহযোগিতার মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব।

৩. নেতৃত্বে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা: দুর্নীতি-রোধে কঠোর পদক্ষেপ ও জনকল্যাণমুখী নীতি প্রণয়ন আবশ্যক।

ডেনমার্ক ও নিউজিল্যান্ডের দুর্নীতি কমানোর অভিজ্ঞতা এ বিষয়ে দৃষ্টান্ত।

৪. গণমাধ্যম ও সচেতনতা বৃদ্ধি: সাহিত্য, নাটক ও সিনেমার মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ ও সহযোগিতার গুরুত্ব প্রচার।

‘পে ইট ফরোয়ার্ড’ (Pay It Forward) চলচ্চিত্রটি দেখিয়েছে, কিভাবে এক ছোট সহানুভূতিশীল কাজ সমাজে বিশাল পরিবর্তন আনতে পারে।

৫. ব্যক্তিগত পর্যায়ে দায়িত্ববোধ ও সচেতনতা: প্রতিবেশীর খোঁজখবর নেওয়া, পরিবেশবান্ধব জীবনধারা পালন, সামর্থ্য অনুযায়ী দান-সেবা—এই ছোট ছোট উদ্যোগ থেকেই শুরু হতে পারে পরিবর্তন।

মনোবিজ্ঞান গবেষণা প্রমাণ করে, অন্যের জন্য সাহায্য করলে ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য ও সুখ বৃদ্ধি পায়।

উপসংহার : স্বার্থপরতা আর কোনো ব্যক্তিগত দুর্বলতা নয়, এটি একটি সামাজিক মহামারি, যা আমাদের সমাজের ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, মানবজাতি সহযোগিতা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে সংকট মোকাবিলা করেছে। এই পৃথিবী ‘আমার’ একার নয়, এটি আমাদের সকলের। এখন সময় এসেছে আবার ‘আমরা’ কে আবিষ্কার করার—একটি সহমর্মী, দায়িত্ববান ও টেকসই সমাজ গঠনের যাত্রা শুরু করার।

রেফারেন্স:

Harvard Study of Adult Development (2020)

Oxfam Inequality Report (2023)

United Nations Climate Change Reports (2022)

Charity Aid Foundation World Giving Index (2023)

Journal of Personality and Social Psychology (2021)

মুক্তিবাণী

পাঠকের মন্তব্য

ফেসবুকে

সর্বশেষ আপডেট

ভিডিও