ডাক্তার সাহেব থেকে ‘স্যার’: ঔষধের দামে প্রাণ যায়, চেম্বারে জমে ‘গিফটের সিন্দুক’

ছবি মুক্তিবাণী
ছবি মুক্তিবাণী
মনিরুজ্জামান মনির

✦ ভূমিকা: এক সময় ছিলেন ‘ডাক্তার বাবু’— রোগীর বাড়িতে গিয়ে দেখে আসতেন, ফ্রি ওষুধ দিয়ে দিতেন। আজকের বাংলাদেশে সেই ডাক্তার ‘স্যার’— যার চেম্বারে ঢুকতেই চোখে পড়ে দামি গাড়ির চাবি, দেয়ালে বিদেশ ভ্রমণের ছবি আর ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির লাইন। রোগীরা যেখানে ঔষধের দাম মেটাতে হিমশিম, সেখানে চিকিৎসকদের দপ্তর ভরে উঠছে গিফটের পসরা, ল্যাপটপ, এয়ার কন্ডিশনার, বিদেশ সফরের টিকিট, এমনকি ফ্ল্যাটের ডাউনপেমেন্ট পর্যন্ত।

কেন এভাবে বদলে গেলো ডাক্তার-রোগীর সম্পর্ক? কেন বাংলাদেশে চিকিৎসা এখন জীবনরক্ষার পথ নয়, বরং দুঃস্বপ্নের নাম?

ছবি মুক্তিবাণী

✦ ১. ‘সেবা’ থেকে ‘ব্যাবসা’: এক পেশার অধঃপতন, একসময় ডাক্তারি ছিল ত্যাগের পেশা। “প্রথম সেবা, পরে অর্থ”— এটাই ছিল নীতিবাক্য। কিন্তু সেই নীতি আজ পরিণত হয়েছে ‘প্রথম কমিশন, পরে প্রেসক্রিপশন’-এ।

ঔষধ আইন ১৯৪০ অনুযায়ী: চিকিৎসককে প্রেসক্রিপশনে অবশ্যই জেনেরিক নাম লিখতে হবে। রোগী যাতে ব্র্যান্ডের ফাঁদে না পড়েন, মানসম্মত ওষুধ নিতে পারেন। তবে বাস্তবে এর উল্টোটাই হচ্ছে।

✦ বেশিরভাগ ডাক্তারই নির্দিষ্ট কোম্পানির ব্র্যান্ড নাম দিয়ে প্রেসক্রিপশন দেন, কারণ কোম্পানির পক্ষ থেকে তারা পাচ্ছেন নগদ অর্থ, উপহার এবং অন্যান্য সুবিধা।

✦ এমনকি রোগীদের জন্য দেওয়া ঔষধের স্যাম্পলেও রোগীর স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা ও গুণগত মান যাচাই হয় না

✦ ২. ডায়াগনস্টিক ফাঁদ: রোগীর গলা কেটে কমিশন, ডাক্তারের কাছে গেলেই রোগীকে ধরিয়ে দেওয়া হয় একগাদা টেস্টের লিস্ট। কেন? কারণ নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠালে চিকিৎসক পান কমিশন।

✦ সাম্প্রতিক ঘটনা: সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেলের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ শহিদুল ইসরাম খান এক শিশুর জন্য ৩০০০ টাকার টেস্ট দেন। রোগীর পরিবার মৌলভীবাজারের অন্য ডায়াগনস্টিকে করায়। রিপোর্ট দেখেই চিকিৎসক ক্ষুব্ধ— “এই রিপোর্ট ভুল” বলে ফের টেস্ট করতে বলেন পছন্দের সেন্টারে। বাধ্য হয়েই পরিবার আবার টাকা খরচ করে। বিষয়টি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা এবং অনলাইন পোর্টালে প্রচার হয়েছিল।

✦ কমিশনের নিয়মিত লেনদেন: ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো ডাক্তারের টেস্ট-রেফারেল বাবদ নগদ টাকা দিয়ে থাকে। ফলে রোগীর দরকার হোক বা না হোক, টেস্ট লিখে দেওয়া হয়।

✦ ৩. চেম্বারের বেহাল দশা: গিফটের ভিড়ে রোগী অসহায়, হাসপাতাল বা চেম্বারে রোগীর সংখ্যার চেয়ে বেশি থাকে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি। বিকাল ৩টা থেকে রাত ১০টা— এই ৪ ঘণ্টায় ৮০-৯০ জন রোগী, ক্ষেত্র বিষেশে ১৫০ জন। কিন্তু এ সময় ১০-১৫ জন রিপ্রেজেন্টেটিভ ডাক্তারদের কাছে গিফট অফার, নতুন ক্যাটালগ, সিঙ্গাপুর সফরের আমন্ত্রণ নিয়ে হাজির। এক কথায় ডাক্তার যতক্ষন আছেন, রিপ্রেজেন্টেটিভও আছেন।

✦ সিনিয়র সাংবাদিক এস এম মেহেদী হাসানের অভিজ্ঞতা: ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলেন একজন চিকিৎসকের চেম্বারে। বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধি প্রেসক্রিপশন ছবি তোলার চেষ্টা করেন এবং বাধা দিলে মারধর করার চেষ্টা করেন। চিকিৎসক ও ফার্মেসি মালিকের সহায়তায় রক্ষা পান।

✦ চিকিৎসকদের প্রভাব: কোম্পানির দেওয়া নগদ অর্থ, আসবাবপত্র, এমনকি বাজার-ঘাট করার সেবাও পায় অনেক চিকিৎসক। এর বিনিময়ে প্রেসক্রিপশন হয় কোম্পানি নির্ভর।

✦ ৪. রোগীর জন্য মৃত্যু ফাঁদ: টাকা নেই তো বাঁচার অধিকারও নেই

✦ ডাক্তার ভিজিট: ৭০০–২০০০ টাকা।

✦ ঔষধ: ৩,০০০–৪,০০০ টাকা।

টেস্ট: ৩,০০০–৫,০০০ টাকা।

দিনমজুর, রিকশাওয়ালা, গার্মেন্ট কর্মীর পক্ষে কীভাবে সম্ভব এত ব্যয়? তাই ৬০% গরিব মানুষ ডাক্তারের কাছে যায় না। ডায়াবেটিস, হার্ট, ক্যান্সার— সব ধরা পড়ে শেষ স্টেজে। মৃত্যু হয় বাড়িতে, কারণ ঔষধ কেনার টাকাও থাকে না।

✦ ৫. নৈতিকতার পতন: ‘কসাই’ ডাক্তার বনাম ‘সেবক’ ডাক্তার

আজ ডাক্তার মানেই:

✦ ‘কমিশনের কারিগর’ — রোগী নয়, কোম্পানির স্বার্থ আগে।

✦ ‘গিফটের সিন্দুক’ — যাঁর বাড়ি ভরে বিদেশী ফার্নিচার, ল্যাপটপ, গাড়ি।

✦ ‘অসহায়ের শত্রু’ — যে গরিব রোগীকে ফিরিয়ে দেন। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দেখা যায়, অনেক ডাক্তার ১-২ মিনিটে মাত্র ১ জন রোগী দেখেন। কেউ কেউ প্রতিদিন ১০০-২০০ জন রোগী দেখেন। এ অবস্থায় তাদের কি সময় ও মনোযোগ রোগীর চিকিৎসার জন্য থাকে? এটি কি চিকিৎসা, নাকি শুধুই ব্যবসা?

✦ ৬. দুর্ভাগ্য হলেও ‘আলো’র দেখা: কিছু ব্যতিক্রম যদিও অধিকাংশ চিকিৎসক বাণিজ্যের ফাঁদে পড়েছেন, তবে দু’একজন আছেন, যাঁরা এখনও ‘সেবক’ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

✦ মৌলভীবাজারের কৃতি সন্তান ডাঃ মোহাম্মদ ইয়াহিয়া এর মতো চিকিৎসকরা রোগীদের ঔষধ দিয়ে থাকেন, প্রয়োজন পড়লে নগদ অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন।

✦ তাদের জন্যই হয়তো মানুষের কাছে চিকিৎসকদের সম্মান এখনো কিছুটা টিকে আছে।

✦ ৭. মৌলভীবাজার ও সিলেটের চিকিৎসা পরিস্থিতি:

✦ মৌলভীবাজারের প্রায় ৯০% চিকিৎসককে বাণিজ্যিক চিকিৎসক হিসেবে মানুষ দেখে।

✦ অধিকাংশ চিকিৎসক বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক বা অংশীদার।

✦ সিলেটকে বলা হয় ‘দ্বিতীয় লন্ডন’, সেজন্য চিকিৎসকরা বদলি হতে চান না, কারণ এখানকার বাণিজ্যিক সুযোগ অনেক বেশি।

✦ সরকারের ট্যাক্স ফাঁকির হার চিকিৎসকদের মধ্যে ৮০-৯৫ শতাংশ বলে বিভিন্ন রিপোর্টে উল্লেখ্য

✦ ৮. সামগ্রিক বিশ্লেষণ: বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত এখন রোগীর জীবন নয়, ব্যবসার মাঠে পরিণত হয়েছে। যেখানে রোগীর আর্থিক সামর্থ্যের বাইরে চিকিৎসা খরচ চাপিয়ে দেওয়া হয়। রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক আর বিশ্বাসের নয়, আর্থিক লেনদেন ও স্বার্থের বৃত্ত।

✦ উপসংহার: মুক্তির পথ কি আছে? যদি এ ধারায় চলতে থাকে, তাহলে চিকিৎসা হবে শুধু ‘ধনীদের অধিকার’। গরিবের জন্য থাকবে কষ্ট, ঋণ আর মৃত্যু।

✦ সরকারি হাসপাতালের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি।

✦ ঔষধ কোম্পানির ‘গিফট সংস্কৃতি’ নিষিদ্ধ করা উচিত।

✦ চিকিৎসকদের জন্য বাধ্যতামূলক নৈতিক কোড চালু করা প্রয়োজন।

✦ গরিবের জন্য স্বাস্থ্য বীমা চালু করা অপরিহার্য।

প্রশ্ন: আমরা কাকে চাই— ‘ডাক্তার সাহেব’ যিনি জীবন বাঁচাবেন, না ‘স্যার’ যিনি লাভের হিসাব রাখেন?

মুক্তিবাণী

পাঠকের মন্তব্য

ফেসবুকে

সর্বশেষ আপডেট

ভিডিও