সাংবাদিকতায় বিবেকের মৃত্যু: কে ফিরিয়ে দেবে আমাদের?

ছবি মুক্তিবাণী
ছবি মুক্তিবাণী
মনিরুজ্জামান মনির ;

ভোর পাঁচটা। রাস্তার কোণে ছড়ানো এক টুকরো সংবাদপত্রের ওপর পা পড়তেই চোখ আটকে গেল শিরোনামে —বাংলাদেশে প্রেস ফ্রিডম সূচকে দশ ধাপের পতন। হঠাৎ মনে হলো, কাগজের কালি যেন আমার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। আমরা, যারা সমাজের বিবেকের প্রতিনিধিত্ব করি, সাংবাদিকরাই যখন নিজেদের পেশাকে অবজ্ঞা করি, তখন সমাজের ভিত কাঁপবেই না কেন?

ছবি মুক্তিবাণী

গৌরবের অতীত, বেদনার বর্তমান এক সময় আমরা “প্রথম শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী” হিসেবে সমাদৃত হতাম। মানুষ আমাদের দেখত সমাজের আলোকবর্তিকা হিসেবে—যারা সত্যের ঝাণ্ডা উঁচিয়ে রাখত, লোভ-ভয়ের কাছে মাথা নোয়াত না।

অ্যাডভোকেট এম. মাফতুন আহমেদের কথায়: “সাংবাদিকরা এক সময় সমাজের গুণী হিসেবে শ্রদ্ধা পেতেন, আজ এক শ্রেণীর সাংবাদিককে দেখে কেউ কেউ বলে, ‘চাপাবাজ-ধান্দাবাজ’, ‘একটা টাউট।’”

২০২৪ সালের সেই কালো দিন যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় সাংবাদিক-বিরোধী বিষোদ্গার এবং মামলার হুমকি জাতিকে দ্বিখণ্ডিত করল, তখনই বুঝলাম—আমাদের কপালে “বিবেক” নামক শব্দটির মৃত্যুচিহ্ন পড়েছে।

কে কলুষিত করছে এই মহান পেশাকে?

ভুয়া পরিচয়ধারীরা: লেখেন না, পড়েন না, অথচ বড় সাংবাদিকের ছদ্মবেশে রাজনৈতিক দলের প্রেস বিজ্ঞপ্তি কপি-পেস্ট করে “খণ্ডিত সত্য” প্রচার করে।

রাজনৈতিক দালাল সাংবাদিকরা: ক্ষমতাধরদের স্বার্থ রক্ষায় সাংবাদিকতার পেছনে লুটপাট চালায়। এদের জন্যই সাধারণ মানুষের চোখে সাংবাদিকতা পরিণত হয়েছে অবমূল্যায়িত পেশায়।

মামলা-ব্যবসায়ীরা: সমালোচনার জবাবে আদালতের ভয় দেখিয়ে বাকস্বাধীনতা হত্যা করতে উদ্যত।

“আমি সাংবাদিক”—আজ কেন লজ্জার কথা? “সাবধান, আমি সাংবাদিক”—এখনকার দিনে এই ঘোষণায় কেউ হাসে, কেউ মোবাইল রেকর্ডিং চালু করে। কারণ স্পষ্ট:

১. বস্তুনিষ্ঠতার মৃত্যু: টিআরপি, ক্লিকবেট, লাইকের লোভে সত্য বিকৃত।

২. ভয়ের সংস্কৃতি: ক্ষমতাবানদের রুষ্ট হলে চাকরি চলে যাওয়ার ভয়ে নিরপেক্ষতা বলি।

৩. সোশ্যাল মিডিয়ার গণ-আদালত: ‘জাতীয়তাবাদী’ বা ‘দেশদ্রোহী’ লেবেল দিয়ে সাংবাদিকতার নৈতিক ভিত্তি পিষ্ট।

পুনর্জন্মের পথ: বিবেক ফিরিয়ে আনার উপায়

নৈতিকতার শপথ: প্রতিটি সাংবাদিকের হাতে ক্যামেরার পাশাপাশি সততার ব্যাজ থাকা জরুরি।

যুব শক্তির উন্মেষ: তরুণরা গড়ে তুলুক নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ব্রিগেড—যেখানে যোগ্যতা নির্ধারিত হবে সততা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে, রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে।

সোশ্যাল মিডিয়ার সচেতনতা: জনগণ বুঝুক—যে খবর আবেগজাগানিয়, তা যাচাই ছাড়া শেয়ার না করা।

শেষ কথা: মোমবাতি নিভলেও আলো জ্বালানোর পথ থাকে আজ এই পেশা অবজ্ঞিত। আমরা নিজেদের বিশ্বাস হারিয়েছি। কিন্তু যারা সত্যিকার সাংবাদিক, তারা কখনো হাল ছাড়বে না। সময়ের সাফ কথা বলার সাহসই আমাদের আবার সমাজের চোখে মর্যাদার আসনে বসাবে।

প্রতিটি হুমকি, প্রতিটি অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আমাদের বলতেই হবে: “আমি কলম নিয়ে লড়াই করি, কালি দেই রক্ত—তবুও নতজানু নই। কারণ আমি সেই সাংবাদিক, যিনি জানেন: বিবেকের মৃত্যু নেই।”

মুক্তিবাণী

পাঠকের মন্তব্য

ফেসবুকে

সর্বশেষ আপডেট

ভিডিও