২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। ঢাকার রাজপথে লাখো মানুষের উত্তাল ঢল, গণভবন ঘেরাও আর হেলিকপ্টারে করে শেখ হাসিনার দেশত্যাগ—সবই ইতিহাসের এক রক্তাক্ত অধ্যায়। প্রায় ২,০০০ শহীদের আত্মত্যাগে পতন ঘটে ১৬ বছরের একচ্ছত্র স্বৈরতন্ত্রের। সেই বিপ্লবের এক বছর পূর্তিতে এখন প্রশ্ন: এই রক্তস্নাত পথচলায় সাধারণ মানুষ কী পেল?
অর্জন: যা কিছু বদলেছে স্বৈরাচারের অবসান ১৬ বছরের দলীয়কৃত বিচারব্যবস্থা, পুলিশ, র্যাব—সবকিছুকে ব্যক্তি শাসনের হাতিয়ার বানানোর যে সংস্কৃতি, তার অবসান। গুম, খুন, দমনপীড়ন আর বিরোধী দল নিধনের ভয়াল রাজনীতি ভেঙে নতুন রাজনৈতিক শক্তি মাথা তুলেছে। জামায়াতসহ বহু রাজনৈতিক শক্তি তাদের সংগঠন ও কার্যালয় পুনর্গঠন করতে পেরেছে।
মুক্ত বাক্য ও সমাবেশের অধিকার এক সময়ের ভয়ের সংস্কৃতি ভেঙে মানুষ এখন রাস্তায় নামতে পারে। শেখ হাসিনার শাসনে যেখানে কান্নারও অধিকার ছিল না, সেখানে আজ সমালোচনা, প্রশ্ন আর প্রতিবাদের ঝড় বইছে। ছাত্র-জনতার সমাবেশ, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন—সবই এই নতুন সাহসিকতার প্রমাণ।
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগ: নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন এক নতুন দৃষ্টান্ত। শেখ পরিবারের বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ ফেরতের আইনি প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।
অপ্রাপ্তি: যে দায় এখনো রয়ে গেছে দোসরদের বিচারহীনতা শেখ হাসিনার অনুগত মন্ত্রীরা—যেমন আব্দুর রহমান, হাছান মাহমুদ—নিরাপদে বিদেশে অবস্থান করছেন। প্রশাসনের ভেতরে এখনো তার লোকজন ঘাপটি মেরে আছে। জুডিশিয়াল ক্যু আর দলীয়করণ চক্র ভাঙতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি স্পষ্ট। অর্থনৈতিক অস্থিরতা লুটপাটের টাকা এখনো বিদেশেই। লন্ডনে শেখ পরিবারের বাড়ি, যুক্তরাষ্ট্রে জয়ের সম্পদের ফিরিয়ে আনার পথে জটিলতা থেকেই গেছে।
মিডিয়া সিন্ডিকেটের প্রভাব: হাসনাত আব্দুল্লাহর কথায়, “হাসিনার পতন না হলে কোনো মিডিয়া জনগণের পক্ষে দাঁড়াত না।” আজও সময় টিভির মতো প্রোপাগান্ডা চ্যানেল সুশীল সমাজের ছায়া পায়। সাংবাদিকদের রাজনৈতিক আনুগত্যও নতুন শঙ্কা তৈরি করছে।
আন্দোলনের কণ্ঠ: প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, “হাসিনার পতন না হলে কোনো মিডিয়া জনগণের পক্ষে দাঁড়াত না। এই আন্দোলন প্রমাণ করেছে—প্রোপাগান্ডার দিন শেষ।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেত্রী ডা. তাসনিম জারা বলেন, “এই লড়াই কোনো দলের নয়—এটি লুটেরা-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রজন্মের বিদ্রোহ। বিচারহীনতা আর লুটপাটের অবসান না হলে এই রক্তের ঋণ শোধ হবে না।”
বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি আহমেদ আবু জাফর বলেন, “আমাদের সামনে দৃশ্যমান কোনো বৈষম্য এখনো দূর হয়নি। বরং সাংবাদিকদের মধ্যে রাজনৈতিক চর্চা বেড়েই চলেছে। ফলে বৈষম্য দূর হওয়ার বাস্তব সম্ভাবনা এখনো দেখছি না।”
সিনিয়র সাংবাদিক এস এম মেহেদী হাসান বলেন, “শেখ হাসিনার পতন গণতন্ত্রের চর্চা কি বৃদ্ধি হয়েছে! যারা বিগত দিন আওয়ামী লীগের দালালীী করেছে, আজ তারাই বিএনপি-জামায়াত-এনসিপির দালালী করছে। বিচারহীনতা, দলীয় প্রশাসন আর মিডিয়া সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে কোন দিনই ভালো কিছু আসা করা যাবে না।”
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা: আলো-আঁধারের দ্বন্দ্ব আশার আলো ছাত্র আন্দোলন এখনো শক্তিশালী। প্রশাসন ও দলীয়করণের বিরুদ্ধে অবিচল। হিন্দু-মুসলিম, নারী-পুরুষ, মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই বিরল ঐক্য বিভাজনের রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করছে।
ঝুঁকির মেঘ: আওয়ামীমুক্ত প্রশাসন না গড়লে গণভবন ঘেরাওয়ের পুনরাবৃত্তি হতে পারে। নতুন নেতৃত্ব যদি আগের পথেই হাঁটে, তাহলে মানুষ ১৫-১৬ বছরের অন্যায় ১৫-১৬ মাসে হলেও ক্ষমা করবে না।
উপসংহার: রক্তের ঋণ শোধের প্রতিশ্রুতি “স্বৈরাচারের পতন ন্যায়ের কাছে অন্যায়ের পতন”—কাদের সিদ্দিকীর এই উক্তি আজও প্রাসঙ্গিক। ২,০০০ শহীদের তাজা প্রাণ কেবল এক স্বৈরাচারকে সরায়নি, দিয়েছে গণতন্ত্রের নতুন সুযোগ। তবে সেই সুযোগ যদি আবার গোষ্ঠীস্বার্থ আর লোভের কাছে বিক্রি হয়, তবে এই বিপ্লবও ব্যর্থ হবে।
মানুষ আজও চায়—
• দোসরদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক,
• লুটেরা অর্থ ফিরিয়ে আনা হোক,
• প্রশাসন হোক অন্তর্ঘাতমুক্ত।
শুধু তখনই রক্তের ঋণ শোধ হবে। না হলে ইতিহাস আবারও পথে নামাবে বাংলাদেশকে।
পাঠকের মন্তব্য