স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে— তবু মৌলভীবাজারের মতো সীমান্তবর্তী জেলা ক্রমেই অপরাধের আবাসভূমিতে পরিণত হচ্ছে। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া, দুর্বল প্রশাসন, বিচারহীনতা আর যুবসমাজের বিপথগামিতা যেন একই সুতোয় গাঁথা হয়ে আজকের এই অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
স্থানীয়রা প্রশ্ন তুলছেন— ‘এমন বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম?’
অপরাধের চিত্র: পরিসংখ্যানে ও ঘটনাপ্রবাহে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও দখলদারি: গত এক বছরে অন্তত ২০টির বেশি এলাকায় স্থানীয় সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে, যেখানে ছোটখাটো বিবাদকে কেন্দ্র করে প্রাণহানি ঘটেছে।
* ধর্ষণ: জেলা নারী ও শিশু সহায়তা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে মৌলভীবাজারে ধর্ষণের মামলা বেড়েছে প্রায় ৪০%।
* খুন ও কিশোর গ্যাং: শহরাঞ্চলে নতুনভাবে কিশোর গ্যাং কালচার বিস্তার লাভ করছে। গত ছয় মাসে অন্তত তিনটি সশস্ত্র হামলায় কিশোর বা তরুণ নিহত হয়েছেন।
* প্রাকৃতিক সম্পদ দখল: নদী, বালুমহল ও পাথর কোয়ারি দখল নিয়ে দখলবাজ চক্র প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার ছত্রচ্ছায়ায় সিন্ডিকেট চালাচ্ছে।
* চাঁদাবাজি ও মামলা বাণিজ্য: ব্যবসায়ী, ইজারাদার থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র দোকানদার পর্যন্ত সবাই কোনও না কোনও চাঁদাবাজির শিকার। মামলা বাণিজ্য এখন পুরো জেলার অজানা কোনো বিষয় নয়।
* কে দায়ী? (১️) রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা অভিযোগ আছে, ক্ষমতাসীন দলের একটি অংশ বালুমহল, বাজার ইজারা ও অন্যান্য অবৈধ দখলদারি কর্মকাণ্ডে সরাসরি জড়িত। স্থানীয় ব্যবসায়ী মিঠু (ছদ্মনাম) বলেন, ‘‘প্রতিবাদ করলে মামলা খাইতে হয় বা হামলার শিকার হতে হয়।’’
২️) প্রশাসনিক দুর্বলতা : জেলা প্রশাসন ও পুলিশের একাংশের সঙ্গে প্রভাবশালীদের সখ্যতা থাকায় অপরাধীরা সহজেই বাঁচছে। এক সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘‘চাপে পড়ে পুলিশের হাত-পা বাঁধা থাকে। ফলে অপরাধের ভয় উবে যায়।’’
৩️) বিচার প্রক্রিয়ার জটিলতা: দীর্ঘসূত্রিতা আর প্রভাবশালী তদবিরে বছরের পর বছর মামলার নিষ্পত্তি হয় না। ফলে নির্যাতিতদের ন্যায়বিচার পাওয়া দূরে থাক, উল্টো হয়রানি বাড়ে।
৪️) বেকারত্ব ও দিকভ্রষ্টতা: মৌলভীবাজারের একটি বড় অংশ এখনো চা বাগান ও কৃষি নির্ভর। বিকল্প আয়ের সুযোগ সীমিত হওয়ায় অনেকেই মাদক ও অস্ত্রের ব্যবসায় জড়িয়ে যাচ্ছে।
আইন ও ধর্মের দৃষ্টিকোণ: জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট সারা বেগম বলেন,“নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ অনুযায়ী ধর্ষণসহ সহিংস অপরাধের শাস্তি কঠোর। কিন্তু যখন রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক দুর্বলতা থাকে, তখন আইনের শাসন ভেঙে পড়ে। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ছাড়া উপায় নেই।”
অপরদিকে মৌলভীবাজারের প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ মোঃ আব্দুল হক ( প্রিন্সিপাল জামেয়া ইসলামিয়া আলিম মাদরাসা মৌলভীবাজার ) বলেন “ইসলামে অন্যায় ও দখলদারি অপরাধের শামিল। আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট বলেছেন, ‘অন্যায়ের সঙ্গে সহযোগিতা কোরো না।’ (সূরা মায়িদা: ২)। ধর্ষণ ও খুনের মতো জঘন্য অপরাধের শাস্তি অত্যন্ত কঠোর। সমাজে আল্লাহভীতি না থাকলে আইন দিয়েই সব ঠিক রাখা সম্ভব নয়।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের পরিসংখ্যান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ জরিপ (২০২৫) অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০২৪ সালে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও চাঁদাবাজির মামলার হার বেড়েছে ৩২%। এর মধ্যে সীমান্তবর্তী জেলা মৌলভীবাজার, কক্সবাজার, সিলেট, ঠাকুরগাঁও-এ অভিযোগের হার তুলনামূলক বেশি।
✳️ উত্তরণের পথ কী?
★ দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন: রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, স্বচ্ছ প্রশাসন ছাড়া অপরাধ নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব।
★ দ্রুত বিচার: বিশেষ ফাস্ট ট্র্যাক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দ্রুত সাজা কার্যকর করতে হবে।
★ যুব সমাজকে মূলধারায় ফেরানো: মাদক ও অস্ত্রের সহজলভ্যতা বন্ধে অভিযান জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি টেকসই কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
★ সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম: নীরব দর্শক না হয়ে সক্রিয়ভাবে দুর্নীতি ও অপরাধের খবর তুলে ধরতে হবে।
শেষ কথাঃ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও মৌলভীবাজারের মতো জেলা যদি অপরাধীর অভয়ারণ্যে পরিণত হয়, তবে সেই দায় রাষ্ট্র, সমাজ ও আমাদের সবার। শহীদের রক্তে কেনা নতুন বাংলাদেশ যেন অপরাধের কাছে মাথা নত না করে— এই প্রত্যাশা নিয়েই এখনই সময় জবাবদিহিতা আর ন্যায়বিচার ফিরিয়ে আনার।
পাঠকের মন্তব্য