“স্যার!” “ম্যাডাম!”—বাংলাদেশের সরকারি অফিস, আদালত বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন হাজারবার উচ্চারিত হয় এই সম্বোধনগুলি। কিন্তু এই শব্দদুটির উৎস কী? বাংলাদেশের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ধারায় কি এর কোনো ঐতিহ্য ছিল? গবেষণা বলছে, ‘স্যার’ ও ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন আমাদের মধ্যে ঢুকেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে, যা আজও টিকে আছে কর্তৃত্ব ও আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে।
ঔপনিবেশিক শিকড়: ‘স্যার’ ও ‘ম্যাডাম’-এর ইতিহাস: অক্সফোর্ড অভিধান অনুযায়ী, ‘স্যার’ শব্দের প্রথম ব্যবহার ১২৯৭ সালে, ব্রিটিশ ‘নাইট’ উপাধিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সম্মানে। শব্দটির উৎপত্তি ফরাসি ‘স্যায়ার’ (Sire) থেকে, যার অর্থ ‘প্রভু’ বা ‘কর্তৃপক্ষ’। অন্যদিকে ‘ম্যাডাম’ এসেছে ফরাসি ‘Madame’ থেকে, যা বিবাহিত নারীদের সম্বোধনের জন্য ব্যবহৃত হতো।
ভারতীয় লেখক উদয়লাল পাই-এর মতে, ‘SIR’ শব্দটি ব্রিটিশরা ব্যবহার করত ‘Servant I Remain’ (আমি চাকরই রয়ে গেলাম) বোঝাতে। অন্যদিকে ফ্রান্সে এটি ‘Slave I Remain’ (আমি দাসই রয়ে গেলাম) হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এই শব্দগুলি ভারতীয় উপমহাদেশে এসেছে ব্রিটিশ শাসনামলে, যখন স্থানীয়রা শ্বেতাঙ্গ কর্মকর্তাদের আনুগত্য প্রকাশ করতে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বলতেন।
বাংলায় সম্বোধনের বিবর্তন: ‘মাস্টারমশাই’ থেকে ‘স্যার’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তাঁর ‘ঔপনিবেশিকোত্তর ঔপনিবেশিক মন’ গ্রন্থে লিখেছেন, বাংলার ঐতিহ্যবাহী সম্বোধন যেমন ‘মাস্টারমশাই’, ‘পণ্ডিতমশাই’ বা ‘হুজুর’ ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে ‘স্যার’ ও ‘ম্যাডাম’-এর প্রচলন শুরু হয়। মুঘল আমলে রাজকর্মচারীদের ‘সাহেব’ বলা হতো, যা আরবি ‘সাহাবা’ (সঙ্গী) থেকে এসেছে। কিন্তু ব্রিটিশরা ‘স্যার’ ও ‘মেমসাহেব’ (ইউরোপীয় নারীদের জন্য) শব্দ চালু করলে তা কর্তৃত্বের প্রতীকে পরিণত হয়।
আধুনিক বাংলাদেশে: সম্মান নাকি কর্তৃত্বের খেলা? ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবীদের ‘স্যার/ম্যাডাম’ সম্বোধন বাতিল করা হলেও আজও ১৬তম গ্রেডের ঊর্ধ্বে কোনো কর্মকর্তাকে ‘স্যার’ না বললে তা অসৌজন্যমূলক মনে করা হয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থী বা কর্মকর্তা-কর্মচারী সম্পর্কেও একই চিত্র। প্রশ্ন উঠেছে—এই সম্বোধন কি এখনও শ্রদ্ধার প্রকাশ, নাকি ঔপনিবেশিক মানসিকতারই প্রতিফলন?
লর্ড ম্যাকলে ১৮৩৫ সালে তাঁর ‘মিনিটস অব ইন্ডিয়ান এডুকেশন’-এ লিখেছিলেন, “উপনিবেশে এমন এক শ্রেণি তৈরি করতে হবে, যারা রঙে ভারতীয় কিন্তু মননে ব্রিটিশ।” ‘স্যার’ ও ‘ম্যাডাম’ সম্বোধনের মাধ্যমে সেই মনস্তত্ত্বই কি আজও আমাদের মধ্যে জীবিত?
আউট্রো: ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি সামাজিক সম্পর্ক ও ক্ষমতারও দর্পণ। ‘স্যার’ ও ‘ম্যাডাম’ সম্বোধনের মাধ্যমে আমরা কি স্বাধীন দেশেও ঔপনিবেশিক মানসিকতারই চর্চা করছি? নাকি সময় এসেছে বাংলার নিজস্ব সম্বোধন ফিরিয়ে আনার? উত্তর হয়তো আমাদেরই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্যে নিহিত।
পাঠকের মন্তব্য