রাজনীতির মৃত্যু ও হিংসার উত্থান

মনিরুজ্জামান মনির

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক সময় আদর্শ, নীতি ও জনসেবাই ছিল মূল চালিকাশক্তি। স্বাধীনতাপূর্ব ছাত্রনেতারা ডাইনিংয়ে ফ্রি খাবারের জন্য নয়, মানুষের অধিকার আদায়ে রাজপথে নামতেন। কিন্তু আজ রাজনীতি পরিণত হয়েছে ক্ষমতা ও স্বার্থের লড়াইয়ে, যেখানে নীতির স্থান হয়েছে গৌণ। অ্যারিস্টটলের মতে, রাজনীতি হওয়া উচিত ছিল “প্রধানতম বিজ্ঞান”—ন্যায়, সমতা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে সমাজ গঠনের মাধ্যম। বাস্তবে এখন তা “রাজার নীতি”-তে পর্যবসিত, যেখানে ব্যক্তিস্বার্থই মুখ্য।

ছবি মুক্তিবাণীঅবক্ষয়ের চিত্র: শিক্ষা-চরিত্রের স্থলে সন্ত্রাসের রাজত্ব সমকালীন রাজনীতির ভয়াবহ রূপান্তর নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোতে স্পষ্ট—

শিক্ষা ও চরিত্রের অবমূল্যায়ন: উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী ও সৎ চরিত্রবানরা এখন রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। তাদের স্থান দখল করছে স্বল্পশিক্ষিত দুর্বৃত্ত ও অর্থলোভী গোষ্ঠী।

সন্ত্রাসের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ: বর্তমানে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মূল হাতিয়ার হলো মারামারি, সন্ত্রাস ও হত্যা। ‘মেনটেন করা’ সন্ত্রাসী গ্রুপ ও রক্তপাতের ক্ষমতাই ‘নেতা’ হওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা হয়ে উঠেছে।

নৈতিক পতনের চূড়ান্ত: রাজনীতিবিদদের অশ্লীল বক্তব্য, চরিত্রহনন ও ঘৃণার সংস্কৃতি এখন দৈনন্দিন ঘটনা। ডা. মুরাদ হাসানের মতো নেতাদের কাণ্ড রাজনীতির ‘নিম্ন সীমা’ নির্ধারণ করেছে।

সিনিয়র সাংবাদিক খায়রুজ্জামান কামাল বলেন, “যখন ছাত্ররাজনীতি সুবিধা ও পদলোভের ফাঁদে পড়ে যায়, তখন পুরো রাজনৈতিক কাঠামোই দুর্বৃত্তায়িত হয়। দেশে এখন নীতি নয়, লাঠিই রাজনীতি ঠিক করে।”

সিনিয়র সাংবাদিক এস এম মেহেদী হাসান বলেন, “একসময় রাজনীতি ছিল সাধারণ মানুষের আশ্রয়স্থল, এখন তা রক্তচোষা সিন্ডিকেটে রূপ নিয়েছে। রাজনীতিকে ব্যবসায় পরিণত করার খেসারত দিচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহমুদুল হক বলেন, “রাজনীতির পুনর্জাগরণ সম্ভব যদি আমরা শিক্ষিত তরুণদের রাজনৈতিক নেতৃত্বে ফিরিয়ে আনতে পারি। নৈতিক শিক্ষা ও সহনশীলতার চর্চা ছাড়া বিকল্প নেই।”

পতনের কারণ: ব্যবসায়িকীকরণ ও আদর্শের মৃত্যু রাজনীতির এই দুর্দশার পেছনে কাজ করছে একাধিক কাঠামোগত ব্যর্থতা—

১। লাভের হাতিয়ারে পরিণত হওয়া: রাজনীতি এখন ‘সবচেয়ে লাভজনক পেশা’—ক্ষমতা, ব্যবসা ও দুর্নীতির অবাধ সুযোগ তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়।

২। আদর্শিক শূন্যতা: বামপন্থী ‘ফুলটাইমার’ যারা জীবন উৎসর্গ করতেন, তাদের স্থান দখল করেছে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। ফলে বিরোধিতা এখন আদর্শের লড়াই নয়, শত্রুতায় রূপ নিয়েছে।

৩। যুবশক্তির অপসারণ: মেধাবী তরুণ প্রজন্ম রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, যা দুর্বৃত্তায়নকে ত্বরান্বিত করছে।

পুনরুত্থানের পথ: নীতির রাজত্ব ফিরিয়ে আনতে, এই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় একরাতেই তৈরি হবে না, তবে কয়েকটি মৌলিক পরিবর্তন জরুরি—।

• নৈতিক শিক্ষার একীকরণ: রাজনীতি অধ্যয়নকে শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার মডেল অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের নাগরিক দায়িত্ব, ন্যায় ও সমালোচনামূলক চিন্তার দক্ষতা শেখাতে হবে।

• সহনশীলতার সংস্কৃতি পুনঃস্থাপন: অ্যারিস্টটল থেকে গান্ধী পর্যন্ত সকল দার্শনিকের মূল বার্তা ছিল—বিদ্বেষ নয়, সংলাপ। রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে ভিন্নমতকে শ্রদ্ধার চোখে দেখার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।

• নৈতিক নেতৃত্বের উদাহরণ: ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সবুরের মতো নেতারা প্রমাণ করেন যে, শেকড়ের প্রতি মমতা ও নিঃস্বার্থ সেবার মনোভাব এখনো সম্ভব।

ছবি মুক্তিবাণী

উপসংহার: রাজনীতি কি মৃত, নাকি পুনর্জন্মের অপেক্ষায়? “রাজনীতি” শব্দটি যেন আর “রাজার নীতি” না হয়ে “রাজ্যের নীতি”-তে রূপ নেয়—জনগণের কল্যাণই যার একমাত্র লক্ষ্য। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে নীতির রাজারা একসময় ছিলেন, তাদের ফিরিয়ে আনাই এখন জাতীয় কর্তব্য। কারণ, ক্ষমতাই শেষ কথা নয়, ন্যায় ও নীতিই চিরন্তন। এ যাত্রাপথে সংবাদমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও নাগরিকদেরই নৈতিক পুনর্জাগরণের অগ্রদূত হতে হবে।

মুক্তিবাণী

পাঠকের মন্তব্য

ফেসবুকে

সর্বশেষ আপডেট

ভিডিও