জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৪

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে ফয়সালা হবে রাজপথে

মুক্তিবাণী অনলাইন ডেক্স :

বিপুল উৎসাহ, উদ্দীপনা, সেই সাথে সহযোদ্ধা হারানো, গুম, খুন, মামলার পাহাড়ে জর্জরিত নেতাকর্মীরা মর্মবেদনা নিয়ে গতকাল রোববার উপস্থিত হয় সিলেট বিভাগীয় তারুণ্যের সমাবেশে। সমাবেশে দলে দলে উপস্থিত ছিল লক্ষনীয়। বিকেলে সমাবেশ শুরু কথা থাকলেও সকাল থেকেই মাঠে আসতে থাকেন বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এরই মধ্য বিশাল মাঠের একাংশ নেতাকর্মীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে। সমাবেশে যোগ দিতে এরই মধ্যে ছোট ছোট মিছিল নিয়ে আলিয়া মাদরাসা মাঠের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের শত শত নেতাকর্মী। ভয়কে জয় করার অদম্য ইচ্ছে, চেতনা ছিল তাদের চোখে মুখে। তাদের গর্জনে কাঁপছিল নগরীর রাজপথ।

জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এসএমএ জিলানীর সভাপতিত্বে ও যুবদলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিল্টন, স্বেচ্ছাসেবকল দলের সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসান ও ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েলের সঞ্চালনায় সমাবেশে বিশেষ বক্তার বক্তব্য রাখেন ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবন।

সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য প্রদান করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সমাবেশে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’’ কবিতা আবৃত্তি করে মির্জা ফখরুল বলেন, দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার, লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার! — কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত। তিনি তাদের উপস্থিত ভবিষ্যতের কথা জানিয়ে বলেন, আমরা ৭১ সালে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, ৯০ সালে ছাত্রনেতারা স্বৈরাচারের পতন নিশ্চিত করে গণতন্ত্রের বিজয় নিশ্চিত করেছি।

কিন্তু সেই গণতন্ত্র আজ বিপন্ন। দানবীয় স্বৈরাচারের সরকারের পতন ঘটাতে হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে দেশে শান্তি আসবে না, ১২ জুলাই ঢাকায় তারুণ্যের সমাবেশে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা আসবে। এর কয়েক মাসের মধ্যে দেশ ও জাতির ভাগ্য নির্ধারণ হবে। আপনারা মনে রাখবেন বেআইনিভাবে ক্ষমতায় থাকতে নির্বাচনকে ব্যবহার করছে এই স্বৈরাচারী সরকার।

তিনি আরো বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দেশের জনগণকে বোকা বানিয়েছে, প্রতারণা করা হয়েছে। আগামীতেও তাদের অধীনে নির্বাচনে দেশে পরিবর্তন আসবে না, শান্তি আসবে না। আগামী ১২ জুলাই ঢাকার সমাবেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা আসবে। যার মধ্য দিয়ে দেশের সব মানুষকে জাগ্রত করে এই সরকারকে বিদায় দিয়ে জনগণের নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেশের এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। এজন্য তরুণ সমাজকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। নিজেদের অধিকার আদায়ে রাজপথে নামতে হবে। আসুন সবাই উঠে দাঁড়াই। গতকাল বিকেলে সিলেট নগরীর সরকারি আলিয়া মাদরাসার মাঠে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল আয়োজিত তারুণ্যের সমাবেশে এসব কথা বলেন মির্জা ফখরুল। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভোটাধিকার প্রয়োগ, ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার ও শিক্ষা উপকরণের দাম কমানোসহ বিভিন্ন দাবিতে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

বিকেল সোয়া চারটায় পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হয় সমাবেশ। এতে নতুন ভোটার ও তরুণদের উদ্দেশ্যে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন বিএনপির মহাসচিব। বিএনপির পূর্ব নির্ধারিত তারুণ্যের সমাবেশ উপলক্ষে সকাল থেকেই সিলেট শহরে জড়ো হতে থাকেন দলটির নেতাকর্মীরা। সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার এবং সিলেট জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে আসা যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা সিলেট শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে অবস্থান নিয়ে দুপুরের মধ্যেই আলিয়া মাদরাসার মাঠে জড়ো হন। তারা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিসহ বিভিন্ন স্লোগান দেন। সমাবেশ স্থলের চারপাশে অসংখ্য ব্যানার পোস্টার ও ফেস্টুন টাঙানো হয়।

বিকেলে সমাবেশ শুরুর আগে মাদরাসার মাঠ লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। পরে তা মাঠের চারপাশের সড়কে বিস্তার লাভ করে। এদিকে, একইদিন সিলেট মহানগরীতে এক কিলোমিটারের ব্যবধানে একই সময়ে পাল্টা সমাবেশ করেছে ক্ষমতাসীন দলের সংগঠন যুবলীগ। এ নিয়ে পুরো সিলেটে উত্তেজনা বিরাজ করলেও তেমন কোন অঘটনা ঘটেনি। সিলেট জেলা ও মহানগর যুবলীগের উদ্যোগে রেজিস্ট্রারি মাঠে ‘তারুণ্যের জয়যাত্রার’ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। পৃথক সমাবেশকে ঘিরে সিলেট নগরীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল সতর্ক অবস্থানে। সমাবেশ স্থলের আশপাশে পুলিশসহ সাদা পোষাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দেখা গেছে। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ সতর্কাবস্থায় ছিল বলে জানিয়েছেন এসএমপির অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) সুদীপ দাস।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জনগণরে দাবি আদায়ে বিগত ১৪ বছর ধরে কথা বলার অধিকার বাধা দিয়ে আসছে এই সরকার। দেশ ও জাতি এখন এক কঠিন সময় ও সঙ্কটের মধ্যে উপনীত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতি হিসেবে অস্তিত্ব থাকবে কি না তা কয়েক মাসের মধ্যে নির্ধারণ হবে। এসময়ের মধ্যে দেশ ও জাতির ভাগ্য নির্ধারণ হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ বলছে- তারা সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করবে। কিন্তু কোন সংবিধান? যেটা তারা নিজেদের মতো কাটা ছেঁড়া করেছে সেই সংবিধান? আমরা বলেছি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা। যেটা ১৯৯৬ সালে দেশের সকল মানুষের ঐক্যমতে নির্ধারণ হয়েছিলো। আজকে কেউ ভোট দিতে পারে না। তরুণ প্রজন্ম ভোট দিতে পারে না। এই কথা বলতে গিয়ে অনেককে মেরে পঙ্গু করা হয়েছে। সিলেটের নেতা এম ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়েছে। মির্জা ফখরুল বলেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছিলাম একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা করার জন্য। নিজেদের স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য। যেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না। কিন্তু আজকে ভিন্নভাবে শেখ হাসিনা বাকশাল কায়েম করেছে। বেআইনিভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নির্বাচনকে ব্যবহার করছে। আর তারাই বলে, তাদের অধীনে নাকি দেশে নাকি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়। প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না। তারা মনে করে দেশটা তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি, এটা তাদের জামিদারি। তাদের তালুকদারী। আমরা তাদের প্রজা। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করেছে। তিনি আরো বলেন, আজকে এই সরকার বাংলাদেশ ও জনগণের অনেক কিছু ক্ষতি করেছে। এরা বিদ্যুৎ খাতকে লুটেরা মডেল বানিয়েছে। যা সরকারের রিপোর্টে বলা হয়ছে। অথচ সরকার বলে বাংলাদেশ নাকি উন্নয়নের রোল মডেল। দশ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতুর ব্যয় এখন কতো? আর দেশের কৃষক তার ফসলের দাম পায় না। মানুষ বাজারে গিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারেনা। এককথায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রায় সব খাতে দলীয়করণ করেছে। এই সরকারকে বিদায় করা ছাড়া কোনো পথ নেই। সরকারকে পদত্যাগ করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। তা না হলে ফয়সালা হবে রাজপথে।

নিখোঁজ ইলিয়াস আলীর স্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা তাহসিনা রুশদীর লুনা বলেন, যারা সাংগঠনিকভাবে দক্ষ বেছে বেছে তাদেরকে গুম করা হয়েছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের জনপ্রিয় নেতাদেরকে গুম করা হয়েছে। এটা যে কত কষ্টের ও বেদনাদায়ক সেটা তারাই বুঝে যাদের পরিবারে কেউ গুম হয়েছেন।

সমাবেশে প্রধান বক্তার বক্তব্যে যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান আজ দেশ বাঁচানোর ডাক দিয়েছেন। তার আহ্বানে রাজপখে নেমে এসেছে বাংলার তরুণ সমাজ। আজ তরুণরা জেগে উঠেছে। তরুণরা জেগে উঠলে কোন স্বৈরশাসকই ক্ষমতায় টিকতে পারেনি। এই সরকারও টিকে থাকতে পারবে না। এসময় উপস্থিত জনতাকে সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া ও ঘরে না ফেরার শপথবাক্য পাঠ করান টুকু।

সমাবেশে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হোসেন জীবন, ছাত্রদল সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ, ছাত্রদলের রাকিবুল ইসলাম রাকিব, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্ঠা তাহসীনা রুশদীর লুনা, জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী, মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসেন, নতুন ভোটার সাবিয়া জামান আরিফা, সাদিয়া কাওসার রুহি, বিগত আন্দোলনে পঙ্গুত্ববরণকারী খালেদুর রহমান খালেদ, গুম হওয়া ইফতেকার আহমেদ দিনার এর বোন তাহসিন শারমিন তামান্না, গুম হওয়া ছাত্রদল নেতা জোনায়েদ আহমেদের মা, কবিতা আবৃত্তি করেন শিক্ষার্থী সায়েমা আহমেদ অসীম, মৌলভীবাজার জেলা ছাত্রদলের এম এ চৌধুরী শাহান, শিক্ষার্থী আরিফ উল্লাহসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাকর্মীরা।

এদিকে, বিএনপির তারুণ্যের সমাবেশে আগত নেতাকর্মীদের উপর সরকার দলীয় ছাত্রলীগের হামলায় চুনারুঘাট ছাত্রদলের দুইজন কর্মী আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক সালেহ মোহাম্মদ আদনান।

সর্বশেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০২৩, ০২:৪৮
মুক্তিবাণী

পাঠকের মন্তব্য

ফেসবুকে

সর্বশেষ আপডেট

ভিডিও