বাজারে ডলারের চাহিদা না থাকায় এবং রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে প্রবাহ ভালো থাকায় গত এক সপ্তাহে ডলারের দাম প্রায় ২ টাকা ৯০ পয়সা কমেছে।
বৃহস্পতিবার বেশিরভাগ ব্যাংক রেমিট্যান্সের ডলার কেনার ক্ষেত্রে ১২০ টাকা রেট অফার করেছে। যদিও কিছু ব্যাংক দাবি করেছে, তারা ১২০ টাকা ৫০ পয়সা পর্যন্ত কিনেছে।
তবে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো জানিয়েছে, দিনের শুরুতে কিছুটা বেশি দর থাকলেও শেষ পর্যন্ত কোনো ব্যাংকই ১২০ টাকার বেশি রেট দিতে চায়নি। অথচ সপ্তাহের শুরুতে ব্যাংকগুলো ১২২ টাকা ৮০ পয়সা থেকে ১২২ টাকা ৯০ পয়সা পর্যন্ত রেট অফার করছিল।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “ব্যাংকগুলোর কাছে এখন ডলারের চাহিদা আগের তুলনায় অনেক কম। রেট কমার প্রবণতায় অনেক ব্যাংক ডলার ধরে রাখতে চাইছে না, বরং বিক্রির চেষ্টা করছে। মূলত আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ কম, আর রেমিট্যান্স ও রপ্তানির ইনফ্লো ভালো থাকায় বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে গেছে।”
একটি বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজের কান্ট্রি হেড বলেন, “আগে ব্যাংকগুলো আমাদের কাছ থেকে ডলার চেয়ে ফোন করত, তখন আমরা দিতে পারতাম না। এখন উল্টো পরিস্থিতি। আমি নিজে এক ব্যাংকের কাছে ১০ মিলিয়ন ডলার বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছিলাম, তারা কেবল ১ মিলিয়ন ডলার নিতে চেয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ডলারের দাম আরও কমবে।”
একই অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টরও। তিনি বলেন, “একটি এক্সচেঞ্জ হাউজ থেকে ১২০ টাকা ৮০ পয়সা দরে ৫ মিলিয়ন রেমিট্যান্স ডলার বিক্রির প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু আমাদের ধারণা ছিল রেমিট্যান্সের ডলার আরও কম দামে পাওয়া যাবে। তাই আমরা কিনিনি, কারণ বেশি দরে কিনলে পরবর্তীতে লোকসানে বিক্রি করতে হবে।”
ইনফোগ্রাফ: টিবিএসগত ডিসেম্বরের শুরু থেকে ডলারের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। মাত্র দুই কার্যদিবসে ডলার-টাকার বিনিময় হার দুই দফা রেকর্ড ভেঙে ১২৮ টাকায় পৌঁছায়। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ডলারের দর কমে আসে। তখন অস্বাভাবিক দামে রেমিট্যান্স কেনার অভিযোগে ১৩টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়।
সেসময় গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, “কয়েকটি ব্যাংকের অপরিণত সিদ্ধান্তে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো ইচ্ছেমতো দর বাড়াচ্ছে, যা বরদাশত করা হবে না। ডলারের দাম ঠিক হবে বাংলাদেশের ভেতরে।”
পরে চলতি বছরের মে মাসের মাঝামাঝি বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ব্যবস্থায় চলে যায়, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের মধ্যে দর ঠিক করে ডলার লেনদেন করতে পারে, যা আইএমএফ-এর শর্ত অনুযায়ী। এর পর থেকেই ডলারের দর কমা শুরু হয়।
ডলারের দাম আরও কমবে?
গত কয়েক বছরে সরবরাহের তুলনায় বাজারে ডলারের চাহিদা বেশি ছিল। বিশেষ করে সরকারি আমদানির অনেক পেমেন্ট বকেয়া ছিল, যার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ডলারের প্রয়োজন হতো।
একইভাবে, বেসরকারি খাতেও অনেক এলসির পেমেন্ট বাকি ছিল। ফলে ডলারের দর বাড়লে দ্রুত পরিশোধে আগ্রহ বাড়ে, যা বাজারে চাপে ফেলেছিল।
একটি শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকের ডেপুটি এমডি বলেন, “গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর সরকারি বকেয়া আমদানির বিল পরিশোধের ওপর জোর দেন। তবে রিজার্ভ থেকে ডলার না দিয়ে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে বাজার থেকে সংগ্রহ করতে বলা হয়। এতে তারা বিপুল পরিমাণে রেমিট্যান্সের ডলার কিনেছে। এমনও মাস গেছে, যখন তারা প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ডলার কিনেছে। এসব দিয়েই বকেয়া বিল পরিশোধ হয়ে গেছে। এখন তাদের আর অতিরিক্ত ডলারের প্রয়োজন নেই।”
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, “বর্তমানে দেশে বিনিয়োগ কার্যক্রম প্রায় স্থবির। বিনিয়োগ না থাকলে আমদানিও কমে যায়—বিশেষত মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল। এখন যেটুকু আমদানি হচ্ছে, তার বড় অংশই ভোগ্যপণ্য। এসব পণ্যের আমদানি একটি নির্দিষ্ট স্তরে স্থির থাকে। তাই ডলারের চাহিদা হঠাৎ বাড়ার সম্ভাবনা কম।”
“অন্যদিকে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের প্রবাহ ভালো থাকায় ডলারের সরবরাহ ভালো। ফলে দাম আরও কিছুটা কমতে পারে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনতে শুরু করলে দাম কিছুটা বাড়তে পারে,” যোগ করেন তিনি।