বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায় সম্প্রতি এক বিরল দৃশ্যের জন্ম হয়েছে। একটি বিশাল আকৃতির কুমির স্থানীয় একাধিক পুকুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে—যা এলাকাবাসীর মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক এবং কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে।
২৫ জুন বুধবার বিকেল পর্যন্ত কুমিরটিকে হাতিয়া পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মাসুদুল ইসলাম ওরফে শরীফের বাড়ির পুকুরে দেখা গেছে। স্থানীয় বন বিভাগের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন এবং বন্যপ্রাণী উদ্ধার দলের সহায়তায় কুমিরটিকে উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কোথা থেকে এলো কুমিরটি? স্থানীয় বাসিন্দা মাসুদুল ইসলাম জানান, তিন দিন আগে প্রথমবার কুমিরটিকে তাঁদের বাড়ির পাশের একটি পরিত্যক্ত কাঠঘরে দেখতে পান। তখন আতঙ্কিত গ্রামবাসীরা লাঠি ও টেঁটা নিয়ে ধাওয়া করলে কুমিরটি পাশের একটি পুকুরে সাঁতরে চলে যায়। একাধিকবার স্থান পরিবর্তনের পর সেটি শরীফের নিজস্ব পুকুরে অবস্থান নিতে দেখা যায়।
“বিকেল পর্যন্ত কুমিরটি পুকুরের এক কোণ থেকে আরেক কোণে ঘুরে বেড়িয়েছে,” বলেন মাসুদুল ইসলাম। “রাতের বেলা উৎসাহী লোকজন টর্চলাইট নিয়ে দেখতে এসেছেন, কিন্তু তখন সেটিকে আর দেখা যায়নি।”
কুমিরটির দৈর্ঘ্য আনুমানিক ৪ থেকে ৫ হাত। তার পিঠে হলদে রঙের ছোপ এবং খাঁজকাটা গঠন রয়েছে, যা প্রাথমিকভাবে অনুমান করা হচ্ছে যে এটি মিঠাপানির কুমির (Mugger crocodile বা Crocodylus palustris)।
বাংলাদেশের কুমির: একটি বিপন্ন অস্তিত্ব বাংলাদেশে বর্তমানে দুই ধরনের কুমিরের অস্তিত্ব রয়েছে:
1. লোনা পানির কুমির (Saltwater crocodile, Crocodylus porosus) – মূলত সুন্দরবনে বাস করে
2. মিঠা পানির কুমির (Mugger crocodile, Crocodylus palustris) – প্রায় বিলুপ্তপ্রায়; খুব কম দেখা যায়
বন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনে বর্তমানে প্রায় ১০০–১৫০টি লোনা পানির কুমির রয়েছে। অন্যদিকে, মিঠা পানির কুমির দেশের প্রকৃতিতে প্রায় বিলুপ্ত, যদিও কিছু ব্যক্তিগত বা আধা-প্রাকৃতিক আবাসস্থলে সংরক্ষিত রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তন, নদী ও খালের জলপ্রবাহে বাঁধ, জলাশয়ের দখল, এবং প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস হওয়ায় কুমিরের স্বাভাবিক বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে, তারা কখনো কখনো লোকালয়ে চলে আসছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত: ড. এনামুল হক অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ বনবিভাগের পরামর্শক “কুমির হলো জলজ বাস্তুতন্ত্রের কী-প্রজাতি (keystone species)। তাদের অনুপস্থিতি গোটা খাদ্যশৃঙ্খলকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। দুঃখজনকভাবে, নদী-খাল, বিল এবং জলার বাসস্থান নষ্ট হওয়ায় কুমির লোকালয়ে চলে আসছে। এটা কেবলমাত্র মানুষের জন্য ঝুঁকি নয়, বরং প্রকৃতির ভারসাম্যের জন্যও হুমকিস্বরূপ।”
“বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সুরক্ষা না দিলে ভবিষ্যতে এমন অনুপ্রবেশ আরও বাড়বে।” বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ ও প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী মো. জোহুরুল হক শিপন বলেন, “এ ঘটনা স্থানীয় বন বিভাগের সজাগ হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। শুধু উদ্ধার করলেই হবে না, তার সঙ্গে আবাসস্থল রক্ষা, জনগণের সচেতনতা এবং ভবিষ্যৎ সংঘাত এড়ানোর পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন।”
পরবর্তী পদক্ষেপ কী? নোয়াখালী উপকূলীয় বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক এ কে এম আরিফ-উজ-জামান জানান, “আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। আমাদের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ দল কুমিরটির সন্ধান ও নিরাপদ উদ্ধার নিশ্চিত করতে কাজ করছে। পরে তাকে কোথায় সংরক্ষণ করা হবে, তা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
বর্তমানে কুমিরটি ওই পুকুরে অবস্থান করছে কি না, তা নিয়ে নিশ্চিত নন স্থানীয়রা। তবে তাঁরা বলছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত কুমিরটির অবস্থান শনাক্ত না হচ্ছে, ততক্ষণ তারা উদ্বেগে আছেন।
সমাধান কেবল উদ্ধার নয়: এই ধরনের ঘটনায় কেবল উদ্ধার কার্যক্রমই যথেষ্ট নয়। আবাসস্থল পুনঃস্থাপন, মানুষ-পশু সংঘাত কমাতে সচেতনতা বৃদ্ধি, এবং উপযুক্ত সংরক্ষণ নীতিমালা বাস্তবায়নের এখনই সময়। কুমির শুধু আতঙ্ক নয়—এটি একটি বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই এর নিরাপদ অবস্থান নিশ্চিত করাও আমাদের দায়িত্ব।
পাঠকের মন্তব্য