কুরআন মাজিদের ১৭তম পারা সূরা আল-আম্বিয়া (২১নং সূরা) এর ১ম আয়াত থেকে শুরু হয়ে সূরা আল-হাজ্জ (২২নং সূরা) এর ৭৮নং আয়াত পর্যন্ত বিস্তৃত। এ পারার মূল বিষয়বস্তু ও শিক্ষাগুলো নিম্নরূপ:
১. সূরা আল-আম্বিয়া (নবীদের গল্প): এ সূরায় বহু নবীর সংক্ষিপ্ত কাহিনি বর্ণিত হয়েছে, যেমন ইব্রাহিম (আঃ), মূসা (আঃ), দাউদ (আঃ), সুলাইমান (আঃ), আইয়ুব (আঃ), ইউনুস (আঃ) প্রমুখ। তাদের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে একত্ববাদ, ন্যায়বিচার, ধৈর্য ও আত্মসমর্পণের শিক্ষা দিয়েছেন।
মূল বার্তা: আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা এবং মূর্তিপূজার অসারতা।
* কিয়ামত ও পুনরুত্থানের সত্যতা।
* নবীদের প্রতি অবিশ্বাস ও ঠাট্টার পরিণাম।
২. সূরা আল-হাজ্জ (হজ্জ): এ সূরায় হজ্জের বিধান, কাবা শরিফের মর্যাদা, এবং আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি গভীর চিন্তার আহ্বান রয়েছে।
প্রধান শিক্ষা: আল্লাহর সামনে সমস্ত সৃষ্টির পূর্ণাঙ্গ আত্মসমর্পণ (ইসলাম)।
* দুনিয়ার জীবনের ক্ষণস্থায়ীতা ও আখিরাতের অনন্ত জীবন।
* সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের তাগিদ।
* মানবজাতির সৃষ্টির রহস্য ও পুনরুত্থানের প্রমাণ (যেমন: মাটি থেকে সৃষ্টি, বৃষ্টি দ্বারা মৃত ভূমির পুনর্জীবন)।
বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আয়াত: সূরা আল-হাজ্জ ২২:৪৬: “তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না, যাতে তাদের হৃদয় বুঝতে পারে এবং কান শুনতে পায়? বস্তুত চক্ষু অন্ধ হয় না, বরং হৃদয় অন্ধ হয় যা বক্ষে রয়েছে।”
* সূরা আল-আম্বিয়া ২১:৩৫: “প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করব মন্দ ও ভালো দিয়ে। আর আমার কাছেই তোমরা ফিরে আসবে।”
রমজানের প্রাসঙ্গিকতা: তারাবিহর সালাতে এ পারার তেলাওয়াত মুমিনদেরকে নবীদের সংগ্রামী জীবনের মাধ্যমে ঈমানি শক্তি অর্জন, আল্লাহর একত্বে অবিচল থাকা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা যোগায়। এতে কিয়ামত ও পুনরুত্থানের বর্ণনা মুমিনদেরকে আখিরাতমুখী জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করে।
সংক্ষেপে: ১৭তম পারা নবীদের ইতিহাস, আল্লাহর একত্ব, কিয়ামতের reality, এবং সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার দিকনির্দেশনা দেয়— যা রমজানের আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়া অর্জনের লক্ষ্যের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত।
মাহে রমাদ্বানে এক রোজাদার অন্য রোজাদারদের প্রতি কি রকম আচরন করা উচিৎ
মাহে রমাদ্বান (রমজান মাস) হল আত্মশুদ্ধি, তাকওয়া (আল্লাহভীতি) এবং সামাজিক সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার মাস। এই পবিত্র মাসে একজন রোজাদার অন্য রোজাদারদের প্রতি নিম্নলিখিত আচরণ করা উচিত:
১. সহানুভূতি ও সহমর্মিতা: রোজাদারদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত, বিশেষ করে যারা রোজা রাখতে কষ্ট অনুভব করেন বা অসুস্থ থাকেন। তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া এবং তাদের কষ্ট বুঝতে চেষ্টা করা গুরুত্বপূর্ণ।
২. সহযোগিতা ও সহায়তা: পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের সাথে ইফতার ও সাহরির সময় সহযোগিতা করা উচিত। একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসা এবং প্রয়োজনীয় কাজে সহায়তা করা রমজানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
৩. সদাচরণ ও নম্রতা: রোজাদারদের প্রতি সদাচরণ এবং নম্র আচরণ করা উচিত। রোজার সময় রাগ, ক্রোধ এবং খারাপ আচরণ থেকে বিরত থাকা উচিত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, *”রোজা ঢালস্বরূপ। সুতরাং রোজাদার ব্যক্তি অশ্লীল কথা বলবে না এবং মূর্খের মতো আচরণ করবে না।”* (বুখারি ও মুসলিম)
৪. ইফতারের দাওয়াত: রোজাদারদের ইফতারের দাওয়াত দেওয়া এবং ইফতারে অংশগ্রহণ করা রমজানের একটি সুন্নত। এটি সামাজিক বন্ধন ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি করে। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, *”যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে তার সমপরিমাণ সওয়াব পাবে, তবে রোজাদারের সওয়াব কমবে না।”* (তিরমিজি)
৫. ক্ষমা ও উদারতা: রমজান মাসে ক্ষমা ও উদারতার মনোভাব পোষণ করা উচিত। অপরের ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দেওয়া এবং উদারভাবে আচরণ করা রমজানের শিক্ষা। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, *”যে ব্যক্তি ক্ষমা করে, আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।”* (মুসলিম)
৬. সামাজিক দায়িত্ব: রমজান মাসে গরিব ও অসহায়দের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখা উচিত। তাদের সাহায্য করা, ইফতার ও সাহরির ব্যবস্থা করা এবং তাদের প্রয়োজন পূরণ করা রমজানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
৭. আত্মীয়তা ও সম্পর্ক উন্নয়ন: রমজান মাসে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করা উচিত। তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করা, তাদের খোঁজখবর নেওয়া এবং তাদের সাথে ভালো আচরণ করা রমজানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
৮. আধ্যাত্মিক পরিবেশ সৃষ্টি: রমজান মাসে আধ্যাত্মিক পরিবেশ সৃষ্টি করা উচিত। একে অপরের সাথে ভালো কথা বলা, ধর্মীয় আলোচনা করা এবং ইবাদতের প্রতি উৎসাহিত করা উচিত।
৯. অন্যের রোজার প্রতি সম্মান: রোজাদারদের সামনে রোজা ভঙ্গকারী কাজ বা কথাবার্তা থেকে বিরত থাকা উচিত। যেমন: রোজাদারদের সামনে খাওয়া-দাওয়া না করা বা তাদের রোজার প্রতি অসম্মানজনক আচরণ না করা।
১০. দোয়া ও কল্যাণ কামনা: রোজাদারদের জন্য দোয়া করা এবং তাদের কল্যাণ কামনা করা উচিত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, *”রোজাদারের জন্য ইফতারের সময় একটি দোয়া কবুল হয়।”* (ইবনে মাজাহ)
উপসংহার: মাহে রমাদ্বানে একজন রোজাদার অন্য রোজাদারদের প্রতি সহানুভূতিশীল, সহযোগিতাপূর্ণ, নম্র এবং উদার আচরণ করা উচিত। এই মাসে সামাজিক সম্প্রীতি, আত্মীয়তার বন্ধন এবং আধ্যাত্মিক উন্নয়নের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। রমজানের শিক্ষা ও আদর্শকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি।
সর্বশেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২৫, ০২:১১
পাঠকের মন্তব্য